তর্ক সংগ্রহ অনুসারে অসৎকার্যবাদ কী?

অথবা, অসৎকার্যবাদ সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, ন্যায়দর্শনের অসৎকার্যবাদ সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, অসৎকাৰ্যবাদ বলতে কী বুঝ?
অথবা, নৈয়ায়িকদের মতে অসৎ কার্যবাদ কী?
উত্তর৷ ভূমিকা :
ভারতীয় দর্শনের আস্তিক স্কুলসমূহের মধ্যে বস্তুবাদী দর্শন হিসেবে ন্যায়দর্শন স্বাধীন চিন্তা ও বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং এ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি গৌতম। ন্যায়দর্শনের মূলভিত্তি হলো ‘ন্যায়সূত্র’। নৈয়ায়িকদের মতে, কারণরূপ ঘটনা সবসময় কার্যরূপ ঘটনার আগে ঘটবে, যদিও কারণ কার্যের পূর্ববর্তী ঘটনা তবুও যে কোন পূর্ববর্তী ঘটনা কারণ নয়। কারণকে কার্যের অপরিবর্তনীয় পূর্ববর্তী ঘটনা হতে হবে। আবার যে কোন অপরিবর্তনীয় পূর্ববর্তী ঘটনাকে কারণ বলা যায় না, যেমন- দিন-রাত্রির অপরিবর্তনীয় পূর্ববর্তী ঘটনা হলেও দিনকে রাত্রির কারণ বলা যায় না। সুতরাং যে অপরিবর্তনীয় পূর্ববর্তী ঘটনা শর্তহীন কেবল তাকেই কারণ বলা হয়। নিম্নে অসৎকার্যবাদ আলোচনা করা হলো :
অসৎকার্যবাদ : কার্যকারণ সম্পর্ক ব্যাপারে ভারতীয় দর্শনে দু’টি মতবাদ প্রচলিত আছে। যথা : ক. সৎকার্যবাদ এবং
খ. অসৎকার্যবাদ। সৎকার্যবাদ অনুসারে কার্য উৎপন্ন হওয়ার পূর্বে উপাদান কারণের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় কার্য বিদ্যমান থাকে। যেমন- তৈলরূপ কার্য উৎপত্তির পূর্বে তিলরূপ উপাদান কারণে নিহিত থাকে। কার্যকারণ সম্পর্কে ন্যায়দর্শনের মতবাদ অসৎকার্যবাদ নামে পরিচিত। তাঁরা বলেন, কার্য উৎপন্ন হওয়ার পূর্বে উপাদান কারণের মধ্যে কার্য বিদ্যমান থাকে না। তাঁদের মতে, উপাদান কারণ হলো সৎ এবং কার্য হলো অসৎ। ন্যায়দর্শন মতে ‘সৎ’ হতে ‘অসৎ’-এর উৎপত্তি বা আরম্ভ।
অসৎকার্যবাদের সমর্থনে নৈয়ায়িক দার্শনিকগণ নিম্নোক্ত যুক্তিগুলো প্রদর্শন করেন :
প্রথমত, কার্য যদি উৎপত্তির পূর্বে উপাদান কারণে বিদ্যমান থাকে তবে কার্য উৎপন্ন হলো এ কথা বলা অর্থহীন।
দ্বিতীয়ত, কার্য যদি উৎপত্তির পূর্বে উপাদান কারণে বিদ্যমান থাকে তবে কার্যের উৎপত্তির জন্য নিমিত্ত কারণের প্রয়োজন হয় না। যেমন- মৃত্তিকার মধ্যে যদি ঘট থাকে তবে কুম্ভকারের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু কুম্ভকার ও তার চক্রষষ্টি ছাড়া ঘটের উৎপত্তি সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, কার্য যদি উৎপত্তির পূর্বে উপাদান কারণে বিদ্যমান থাকে তবে কার্য ও উপাদান কারণের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকতো না। উভয়কে একই নামে পরিচিত হতো এবং উভয়েই একই প্রয়োজন সাধন করতো। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। কেউ মৃত্তিকাকে ঘট বলে না এবং মৃত্তিকা দিয়ে জল পানও করে না। ঘটের সাহায্যেই জল পান করে। কাজেই স্পষ্টত যে, নৈয়ায়িকদের মতে কারণ ও কার্যের ভিন্ন সত্তা আছে। তা যদি না হতো তবে কারণ হতে কার্যকে পৃথক করা যেত না।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ন্যায়দর্শন কারণতত্ত্ব সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন। তাঁদের কারণতত্ত্বের সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শনিক মিল-এর সংগতি লক্ষ্য করা যায়। ‘কারণ হলো সদর্থক ও নঞর্থক শর্তের সমষ্টি’-মিলের এ মতের সঙ্গে ন্যায়দর্শনের কারণতত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ সাদৃশ্য রয়েছে।