যোগদর্শনে মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত লিখ ।

অথবা, যোগ মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা কর।
অথবা, যোগদর্শনে চিত্তের বৃত্তি ও ক্লেশ আলোচনা কর।
অথবা, যোগদর্শনে চিত্রের বৃত্তির প্রকার ও ক্লেশের প্রকার আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মহর্ষি পতঞ্জলি যোগদর্শনের প্রবর্তক এবং প্রতিষ্ঠাতা। মহর্ষি পতঞ্জলির নামানুসারে এ দর্শনের নাম পাতঞ্জল দর্শন। পাতঞ্জল দর্শনকে সাংখ্য প্রবচন নামেও অভিহিত করা হয়। তার কারণ, মহর্ষি পতঞ্জলি কপিল মুনি প্রবর্তিত সাংখ্যমত স্বীকার করে সাংখ্য প্রবর্তিত পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব; যথা : পুরুষ, প্রকৃতি, মহত্তত্ত্ব, অহংকার, পঞ্চতন্মাত্র, একাদশ ইন্দ্রিয় এবং পঞ্চ মহাভূত স্বীকার করেছেন। পূর্বোক্ত পঞ্চবিংশতি তত্ত্ব ছাড়া আরো একটি তত্ত্ব পাতঞ্জল দর্শনে স্বীকৃত হয়েছে। এ তত্ত্বটি হলো ঈশ্বর তত্ত্ব। এ কারণে পাতঞ্জল দর্শনের অপর নাম ‘সেশ্বর-সাংখ্য।’
যোগদর্শনে মনস্তত্ত্ব (Yoga Psychology) : সাংখ্য ও যোগদর্শন মতে, আত্মা স্বরূপত মুক্ত। জীব হলো স্থূল ও সূক্ষ্ম শরীর বিশিষ্ট আত্মা। সূক্ষ্ম শরীর ইন্দ্রিয়, মন, অহংকার ও বুদ্ধির দ্বারা সৃষ্ট। সাংখ্যের বুদ্ধি, অহংকার ও মন, এ তিন তত্ত্বের সমষ্টিকেই যোগদর্শনে চিত্ত নামে অভিহিত করা হয়। স্থূল বা সূক্ষ্ম শরীর বা চিত্ত কারো সাথে আত্মা স্বরূপত সম্পর্কযুক্ত নয়। তবে অবিদ্যাবশত আত্মা নিজেকে চিত্ত বলে মনে করে। তাই চিত্তের পরিণামকেও নিজের পরিণাম বলে মনে করে। যদিও সে নিজে অপরিণামী। চিত্ত স্বরূপত অচেতন; তবে আত্মার চৈতন্য চিত্তে প্রতিবিম্বিত হয় বলে, তাকে চেতন বলে প্রতীয়মান হয়।
চিত্তের বৃত্তি পাঁচ প্রকার : বিষয়ের সংখ্যা অগণনীয় বলে চিত্তের সাথে বিষয়ের সংযোগের ফলে চিত্তে অসংখ্য বৃত্তি জন্মে। চিত্তের এ বৃত্তিগুলোকে পাঁচ শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যথা : প্রমাণ বা যথার্থ জ্ঞান, বিপর্যয় বা ভ্রান্ত জ্ঞান, বিকল্প, নিদ্রা এবং স্মৃতি।
১. প্রমাণ : প্রমাণ আবার তিন প্রকার। যথা : প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ। ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে সাক্ষাৎ জ্ঞান হয় তা প্রত্যক্ষ জ্ঞান। যেমন- চক্ষুর দ্বারা ঘাসের সবুজ বর্ণকে প্রত্যক্ষ করা হয়। উপস্থিত কোন বস্তুকে প্রত্যক্ষ করে ব্যাপ্তি জ্ঞানের ভিত্তিতে অদৃশ্য কোন বস্তু সম্পর্কে যে জ্ঞান হয় তাকে অনুমান বলা হয়। যেমন- ধোঁয়া দেখে অদৃশ্য অগ্নির উপস্থিতি সম্পর্কে
জ্ঞান লাভ করা । আপ্ত বা বিশ্বাসযোগ্য কোন পুরুষের বাক্য শ্রবণ করে যে জ্ঞান হয় তাকে শব্দ জ্ঞান বা আগম বলা হয়।
২. বিপর্যয় : যে বস্তু মূলত যে রকম নয় তাকে সে রকম জানার নামই বিপর্যয় বা ভ্রান্তজ্ঞান; যেমন- রজ্জুকে সৰ্প বলে জানা।
৩. বিকল্প : শব্দের অনুরূপ কোন বস্তুর অস্তিত্ব না থাকা সত্ত্বেও শব্দ শুনলে শব্দের প্রভাবে যে জ্ঞান জন্মে তাই ‘বিকল্প’। যেমন- আকাশ কুসুম। আকাশ কুসুম বলে কোন বাস্তব অস্তিত্ব নেই, তবুও ঐ শব্দটি শুনামাত্র আমাদের এক
প্রকার জ্ঞান হয়। এ জ্ঞানই বিকল্প। এটা বিষয়মূল্য জ্ঞান।
৪. নিদ্রা : নিদ্রাও আর এক প্রকার বৃত্তি। মনে তমোগুণের প্রাধান্যে নিদ্রার উদ্ভব হয়। যোগদর্শনে নিদ্রা বলতে সুপ্তিকে বুঝায়। অনেকে মনে করেন নিদ্রায় কোন জ্ঞান হয় না। কিন্তু এ ধারণা ভুল। যোগদর্শন মতে নিদ্রায়ও জ্ঞান হয়। নিদ্রায় যদি কোন অভিজ্ঞতা না হয়। তবে নিদ্রা ভঙ্গের পর কোন লোক তার সুনিদ্রা হয়েছে, এ কথা বলে কেমন করে? পূর্বঅভিজ্ঞতা ছাড়াও তো এটা স্মরণ করা সম্ভব নয়। এটা হতে বুঝা যায়, নিদ্রার অবস্থা একেবারে জ্ঞানহীন অবস্থা নয়। নিদ্রার সময়ও এক প্রকার অনুভূতি হয়। সুতরাং নিদ্রাও মনের এক রকমের বৃত্তি।
৫. স্মৃতি : স্মৃতিও মনের একটি বৃত্তি। পূর্ব অভিজ্ঞতার যথাযথ পুনরাবৃত্তিই স্মৃতি। যেমন- ছাত্র-ছাত্রীরা পরীক্ষার চিত্তের যাবতীয় বৃত্তিই প্রমাণ, সময় তাদের পূর্বের মু খস্থ করা বা অধ্যয়নজাত বিষয়বস্তুর পুনরাবৃত্তি করে। যোগদর্শন মতে, বিপর্যয়, বিকল্প, নিদ্রা ও স্মৃতি এ পাঁচ প্রকার বৃত্তিরই অন্তর্গত।
ক্লেশ পাঁচ প্রকার : আত্মার নিজের কোন বৃত্তি নেই। ভুলবশত চিত্তের বৃত্তিকে আত্মার বৃত্তি বলে মনে করা হয় বলে আত্মাকে পঞ্চ ক্লেশে (Sources of affection) ক্লিষ্ট মনে হয়। যোগদর্শন মতে এ পঞ্চ ক্লেশ হলো অবিদ্যা (Wrong knowledge of the not self as self), f (False nation of the self as identical with the mind), রাগ বা আসক্তি (Desire for pleasure and the means of its attainments), দ্বেষ (Aversion to pain and the causer there of) ও অভিনিবেশ (The instinctive fear of death in all creatures)।
১. অবিদ্যা : যে বস্তু যা নয় তাকে তা মনে করাই অবিদ্যা। যেমন- দুঃখকে সুখ মনে করা, অনাত্মাকে আত্মা মনে করা ইত্যাদি। অবিদ্যা নিজেও ক্লেশ এবং অন্যান্য ক্লেশগুলোরও মূল কারণ।
২. অস্মিতা : আত্মাকে বুদ্ধি বলে মনে করাই অস্মিতা।
৩. রাগ বা আসক্তি : সুখ ভোগের বাসনাই এবং সুখপ্রদ বস্তু লাভের ইচ্ছাই হলো রাগ বা আসক্তি।
৪. দ্বেষ : দুঃখজনক বস্তুর প্রতি বিতৃষ্ণাই হলো দ্বেষ। দ্বেষ রাগের বিপরীত।
৫. অভিনিবেশ : মৃত্যুভয়জনিত ক্লেশই হলো অভিনিবেশ। যোগ দার্শনিকগণ বলেছেন, চিত্তের সর্বপ্রকারের বৃত্তি নিরোধ ব্যতিরেকে সম্প্ৰজ্ঞাত বা অসম্প্ৰজ্ঞাত কোন প্রকারের যোগ সম্ভব নয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, যোগদর্শন মতে, আত্মা, দেহ, মন ও বুদ্ধির অতিরিক্ত এক বিশুদ্ধ চৈতন্যময় আধ্যাত্মিক সত্তা। যোগদর্শন আত্মার মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে খুব সুন্দর এবং প্রাঞ্জল ভাষার আলোকে আলোচনা করেছে। যোগদর্শন সাধারণ মানুষের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষাকে পূর্ণ করতে পারে। সকল রকম রহস্যময়তা দূর করে দিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সত্যানুসন্ধানের প্রেরণা দেয় এই যোগদর্শন।