অথবা, সাংখ্য দর্শনের বিবর্তনতত্ত্ব আলোচনা কর।
অথবা, সাংখ্য দর্শনের বিবর্তন প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।
উত্তর৷৷ ভূমিকা : সাংখ্য দর্শন ভারতীয় দর্শনের প্রাচীনতম চিন্তাধারার মধ্যে অন্যতম। মহর্ষি কপিলদেব সাংখ্য দর্শনের প্রবর্তক ও প্রতিষ্ঠাতা। সাংখ্য দর্শনের আদি গ্রন্থ হলো কপিল প্রণীত ‘তত্ত্ব সমাস’। এছাড়া ‘সাংখ্যকারিকা’, ‘সাংখ্য-প্রবচন-ভাষ্য’, ‘যুক্তিদীপিকা’ সাংখ্য দার্শনিকদের বিখ্যাত গ্রন্থ। সাংখ্য দর্শন দ্বৈতবাদী, নিরীশ্বরবাদী, বস্তু স্বাতন্ত্র্যবাদী এবং পরিণামবাদী। এ দর্শনে পুরুষ ও প্রকৃতি এ দুটি মূলতত্ত্বকে স্বীকার করে। তাছাড়া সাংখ্যসূত্রে মহর্ষি কপিল ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। সাংখ্য দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদ হলো বিবর্তনবাদ।
সাংখ্য বিবর্তনবাদ : সাংখ্য দর্শন বিবর্তনবাদী। তাঁদের মতে, পরিবর্তন এবং বিবর্তনের নির্দিষ্ট নিয়মে সমস্তই একে একে প্রকৃতির গর্ভ হতে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং করছে। বিবর্তনের ফলেই এ রকম অনেক জগতের এবং জীবের সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলো ধ্বংস হয়ে আবার নতুন সৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃতি অফুরন্ত শক্তির উৎস। জগৎ এবং জগতের প্রত্যেক বস্তু ও বিষয়ের মূল কারণ হলো প্রকৃতি। প্রকৃতি নিজ স্বভাবহেতু নিয়মিত সৃষ্টি করে থাকে। প্রকৃতিতে জগৎ অব্যক্ত অবস্থায় অবস্থান করে এবং পরে এ প্রকৃতি থেকেই ক্রমে ক্রমে জগতের বিচিত্র বিবর্তন হয়। নিম্নে সাংখ্য বিবর্তন তত্ত্বটি আলোচনা করা হলো :
১. কখন ও কিভাবে জগতের এ বিবর্তন হয় : জগৎ সৃষ্টির পূর্বে প্রকৃতি সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃগুণের সাম্যাবস্থায় থাকে। প্রকৃতির মধ্যে জগৎ অব্যক্ত থাকলেও প্রকৃতির সাম্যাবস্থার অবসান না ঘটলে জগতের বিবর্তন সম্ভব নয়। প্রকৃতি ও পুরুষের যখন সংযোগ ঘটে তখন প্রকৃতির সাম্যাবস্থার অবসান ঘটে এবং জগতের বিবর্তন আরম্ভ হয়। সুতরাং জগতের অভিব্যক্তির জন্য প্রকৃতি পুরুষের সংযোগ নিতান্তই প্রয়োজন। প্রকৃতি অচেতন ও বোধশক্তিহীন বলে সচেতন ও বুদ্ধিমান
সত্তার নিয়ন্ত্রণ ব্যতিরেকে তার কাজ করা সম্ভব নয়। অপরদিকে, পুরুষ সচেতন ও বুদ্ধিমান হলেও নিজে নিষ্ক্রিয় বলে পুরুষের পক্ষেও একা জগৎ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। সুতরাং প্রকৃতির কর্মক্ষমতা ও পুরুষের বুদ্ধি এ দুটির যখন সংযোগ হয় তখন জগতের অভিব্যক্তি শুরু হয়।
২. বিরুদ্ধধর্মী পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ কিভাবে সম্ভব : সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন পঙ্গু যেমন চলনশক্তিসম্পন্ন অন্ধের স্কন্ধে আরোহণ করে উভয়ে নির্দিষ্ট পথ অতিক্রম করে, তেমনি নিষ্ক্রিয় সচেতন ও বুদ্ধিমান পুরুষ, সক্রিয় অচেতন ও অনুভূতিহীন প্রকৃতি উভয়ে একসঙ্গে একত্রে জগৎ সৃষ্টিরূপ কার্য সম্পন্ন করে।
৩. প্রকৃতি ও পুরুষ তাদের মিলনের ফলে উভয়ে উভয়ের প্রয়োজন সিদ্ধ করে : ‘সাংখ্য দার্শনিকগণ বলেছেন, প্রকৃতি ও পুরুষ তাদের মিলনের ফলে উভয়ে উভয়ের প্রয়োজনকে সিদ্ধ করে। পুরুষের প্রকৃতিকে প্রয়োজন ভিন্ন সত্তাকে জানার জন্য, নিজের ভোগের জন্য আর নিজের মুক্তির জন্য। প্রকৃতি পুরুষের বন্ধনের কারণ, আর বন্ধন ছাড়া মুক্তির প্রশ্নই উঠে না। পক্ষান্তরে, প্রকৃতিরও পুরুষকে প্রয়োজন পুরুষ কর্তৃক দৃষ্ট ও ভোগ্য হওয়ার জন্য ।
৪. বিবর্তনের ক্রম : প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ ঘটলে প্রকৃতির সাম্যাবস্থা ব্যাহত হয় এবং প্রকৃতির মধ্যে একটা তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়। রজঃগুণ স্বভাবত চঞ্চল; তাই রজঃগুণই প্রথমে সক্রিয় হয়ে উঠে এবং পরে সত্ত্ব ও তম গুণের ক্রিয়া আরম্ভ হয়। প্রকৃতিস্থিত প্রতিটি গুণ অপর গুণ দুটির উপর আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করে। ফলে নিম্নে ক্রম অনুসারে
জগতের বিবর্তন ঘটে।
৫. মহৎ : প্রকৃতি হতে প্রথম সৃষ্টি হয় মহৎ বা বুদ্ধির। প্রক
ৃতির এ প্রথম পরিণাম জগতের যাবতীয় বস্তুর বীজ বলে একে মহৎ বলা হয় এবং জীবের মধ্যে বুদ্ধিরূপে প্রকাশিত হয় বলে একে বুদ্ধি বলা হয়। প্রকৃতিতে সত্ত্বগুণের প্রাধান্য হেতু বুদ্ধির অভাব ঘটে। বুদ্ধি নিজেকে যেমন প্রকাশ করে তেমনি অন্যকেও প্রকাশ করে। এ বুদ্ধির সাহায্যেই ভালোমন্দ, ধর্ম ও
অধর্ম, প্রকৃতি ও পুরুষ, জ্ঞান ও অজ্ঞান প্রভৃতির পার্থক্য নির্ণয় করা যায়। পুরুষের চৈতন্য বুদ্ধিতে প্রতিবিম্বিত হয় বলে বুদ্ধিকেও সচেতন বলে মনে হয়; কিন্তু আসলে বুদ্ধি পুরুষও নয়, আর সচেতনও নয়।
৬. অহংকার্ : মহৎ থেকে সৃষ্টি হয় অহংকারের। অহংকার প্রকৃতির দ্বিতীয় পরিণাম। অভিমানই অহংকারের বৈশিষ্ট্য। ‘অহম’ অর্থাৎ আমি এবং মম অর্থাৎ আমার এ দুটি বোধ অহংকারের প্রধান লক্ষণ। এ অহংকারের জন্যই নিষ্ক্রিয় পুরুষ বা আত্মা নিজেকে কর্তা বলে মনে করে এবং প্রিয় বস্তুকে লাভ করার ও অপ্রিয়কে বর্জনের চেষ্টা করে। ফলে পুরুষের সুখ ও দুঃখ ভোগ করতে হয়। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃগুণের প্রাধান্য অনুসারে অহংকার তিন প্রকার। যথা : ১. সাত্ত্বিক, ২. রাজস বা তৈজস এবং ৩.
তামস বা ভূতাদি । সত্ত্বগুণের আধিক্য ঘটলে সাত্ত্বিক, রজঃগুণের আধিক্য ঘটলে রাজস এবং তমঃগুণের আধিক্য ঘটলে তামস অহংকারের সৃষ্টি হয়। সাত্ত্বিক অহংকার থেকে জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় এবং মন এর আবির্ভাব হয়। তামস অহংকার থেকে উদ্ভব হয় পঞ্চতন্মাত্রের, রাজস অহংকারের কাজ হলো সাত্ত্বিক এবং তামস; এ দুই অহংকারকে শক্তি প্রদান করে তাদের বিবর্তনে সাহায্য করা। অহংকার থেকে মোট ১৬টি বিষয়ের সৃষ্টি হয়। সাংখ্য দর্শনে তিনটি অন্তঃকরণ এবং দশটি বাহ্যকরণকে একত্রে ‘ত্রয়োদশকরণ’ বলে। সাংখ্য মতে, বুদ্ধি, অহংকার ও মন এ তিনটি অন্তঃকরণ এবং পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় ও পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় এ দশটি বাহ্যকরণ। সাংখ্য মতে, ইন্দ্ৰিয় বলতে প্রত্যক্ষগোচর শরীরের বহির্দেশে অবস্থিত ইন্দ্রিয়গুলোকে বুঝায় না, তাদের অন্তঃস্থিত অপ্রত্যক্ষ শক্তিকেই বুঝায়। মনকে উভয়েন্দ্রিয় বলা হয়। কারণ মনের সাহায্য ছাড়া কোন ইন্দ্ৰিয়ই কাজ করতে পারে না। সাংখ্য মতে, মন অনিত্য। মন ও অন্যান্য ইন্দ্রিয় সম্পর্কে সাংখ্য মতের সাথে অন্যান্য মতের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।
৭. পঞ্চতন্মাত্র : ‘পঞ্চতন্মাত্র’ হলো রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দ এ পাঁচটি অনুভূতির সূক্ষ্ম উপাদান। পঞ্চতন্মাত্র অতিসূক্ষ্ম বলে তাদের প্রত্যক্ষ করা যায় না, তবে তাদের অস্তিত্বকে অনুমান করা যায়। পঞ্চতন্মাত্র থেকে সৃষ্টি
পঞ্চমহাভূতের যথা : ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এবং ব্যোম।
৮. পঞ্চমহাভূতের বিবর্তনক্রম : ‘শব্দ তন্মাত্র’ থেকে ব্যোম বা আকাশের সৃষ্টি হয় তাই আকাশে শব্দ গুণের উপস্থিতি বিদ্যমান। শব্দ তন্মাত্র এবং স্পর্শ তন্মাত্রের সংযোগের ফলে মরুৎ বা বায়ুর উৎপত্তি হয়। তাই বায়ুর
মধ্যে শব্দ ও স্পর্শ উভয় গুণই বিদ্যমান। শব্দ ও স্পর্শ তন্মাত্রের সাথে রূপ তন্মাত্রের সংযোগের ফলে শব্দ, স্পর্শ রূপ গুণযুক্ত তেজের উৎপত্তি হয়। শব্দ, স্পর্শ, রূপ তন্মাত্রের সাথে রস তন্মাত্রের সংযোগের ফলে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস যুক্ত ‘অপ’ বা জলের উৎপত্তি হয়। শব্দ, স্পর্শ রূপ, রস তন্মাত্রের সাথে গন্ধ তন্মাত্রের সংযোগের ফলে শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ বিশিষ্ট ক্ষিতি বা পৃথিবীর উৎপত্তি হয়। তবে মহাভূতের গুণ সম্পর্কে সাংখ্য মতবাদ ন্যায় মতবাদ থেকে ভিন্ন। প্রকৃতি থেকে মহাভূত পর্যন্ত প্রকৃতির পরিণামগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা : ১. প্রত্যয় মার্গ বা বুদ্ধি মার্গ
এবং ২. তন্মাত্র মার্গ বা ভৌতিক মার্গ। মহৎ, অহংকার, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় এবং মন এ তেরোটি পরিণামকে প্রত্যয় মার্গ বলে। আর পঞ্চতন্মাত্র, পঞ্চয়হাভূত এবং মহাভূত থেকে উৎপন্ন সকল দ্র
ব্য তন্মাত্র মার্গের অন্তর্ভুক্ত।
সমালোচনা : সাংখ্য দর্শনে বিবর্তনবাদ তত্ত্বটি নিম্নোক্তভাবে সমালোচিত হয়েছে।
১. সাংখ্য দার্শনিক মতবাদকে দ্বৈতবাদী, বস্তুবাদ নামে অভিহিত করা যায়। কারণ তারা জগতের ব্যাখ্যায় দুটি মূলতত্ত্বের অস্তিত্বকে স্বীকার করে।
২. সাংখ্য দর্শনে পুরুষ ও প্রকৃতি সংযোগ যুক্তিযুক্তভাবে ব্যাখ্যা করা হয় নি।
৩. সাংখ্য দর্শনে সাম্যাবস্থার বিচ্যুতির বিষয়টি যথাযথভাবে ব্যাখ্যা দিতে পারে নি।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, সাংখ্য মতে পুরুষ ও প্রকৃতি তাদের মিলনের ফলে উভয়ে উভয়ের প্রয়োজনকে সিদ্ধ করে। পুরুষের প্রকৃতিকে প্রয়োজন ভিন্ন সত্তাকে জানার জন্য; নিজের ভোগের জন্য এবং নিজের মুক্তির জন্য। প্রকৃতি পুরুষের বন্ধনের কারণ, আর বন্ধন ব্যতীত মুক্তির প্রশ্নই উঠে না। পক্ষান্তরে, প্রকৃতিরও প্রয়োজন
পুরুষ কর্তৃক দৃষ্ট ও ভোগ্য হওয়ার জন্য। সুতরাং প্রকৃতির কর্মক্ষমতা ও পুরুষের বুদ্ধি এ দুটোর যখন সংযোগ হয় তখন জগতের অভিব্যক্তি বা বিবর্তন আরম্ভ হয়।