অথবা, সাংখ্য দর্শন মতে পুরুষের স্বরূপ বর্ণনা কর। পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ কী সম্ভব?
অথবা, সাংখ্য দর্শন মতে আত্মার স্বরূপ আলোচনা কর। প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ সম্ভব কি না? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : সাংখ্য দর্শন ভারতীয় দর্শনের প্রাচীনতম চিন্তাধারার মধ্যে অন্যতম। এ দর্শনের প্রবর্তক ও প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি কপিল। প্রকৃতি এবং এর পরিণামসহ সমস্ত তত্ত্বকে সংখ্যা দ্বারা বিন্যাস করা হয় বলে একে সাংখ্য দর্শন বলে । দ্বৈতবাদী বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী সাংখ্য দর্শন পুরুষ ও প্রকৃতি এ দুটি পরম সত্তাকে স্বীকার করে। পুরুষ হলো শাশ্বত
চৈতন্যস্বরূপ, যা জাগতিক পরিবর্তন ও ক্রিয়ার সাক্ষী, কিন্তু নিজে অপরিণামী ও নিষ্ক্রিয়।
সাংখ্য মতে, পুরুষ বা আত্মার স্বরূপ : সাংখ্য দর্শনে আত্মাকে পুরুষ বলা হয়। পুরুষ হলো শাশ্বত চৈতন্যস্বরূপ, যা জাগতিক পরিবর্তন ও ক্রিয়ার সাক্ষী, কিন্তু নিজে অপরিনামী ও নিষ্ক্রিয়। সাংখ্য মতে, পুরুষের উৎপত্তি ও বিনাশ নেই। পুরুষ জড় নয়, জড়ের প্রকাশক। পুরুষ নির্বিকার ও পরিবর্তন রহিত। পুরুষ সৃষ্টও নয়, স্রষ্টাও নয়। পুরুষ প্রকৃতিজাত দ্রব্যের স্রষ্টা। পুরুষ ভোক্তা, জ্ঞাতা এবং নির্গুণ। পুরুষ কর্তা নয়। পুরুষ স্বভাবত মুক্ত। পুরুষের বন্ধন স্বাভাবিক নয় অহংকারবশত পুরুষ যখন নিজেকে কর্তা মনে করে, তখন দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে তার অভিন্নত্ববোধ
জন্মে এবং তখনই বন্ধনপ্রাপ্ত হয়। প্রকৃতির যাবতীয় কর্ম ও পরিবর্তনকে পুরুষ স্রষ্টারূপে দর্শন করে। পুরুষ জাগতিক বস্তুর ভোক্তা। টেবিল, চেয়ার প্রভৃতি বস্তু যেমন নিজেরা নিজেদের ভোগে লাগে না, অপরের ভোগের জন্য ব্যবহৃত হয়, তেমন প্রকৃতিজাত বস্তুকে প্রকৃতি ভোগ করে না, পুরুষই তা ভোগ করে। পুরুষ শুদ্ধ, মুক্ত এবং সুখ-দুঃখের অতীত। সাংখ্য মতে, পুরুষ এক নয়, বহু। দেহ ভেদে পুরুষ বিভিন্ন। তাঁদের মতে, পুরুষ বহু না হয়ে এক হলে সকলেরই একই রকম জ্ঞান হতো, একই সঙ্গে জন্ম বা মৃত্যু হতো। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।
বিরুদ্ধধর্মী পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ যেভাবে সম্ভব : সাংখ্য দার্শনিকগণ বলেন, দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন পঙ্গু যেমন চলৎশক্তিসম্পন্ন অন্ধের স্কন্ধে আরোহণ করে উভয়ে নির্দিষ্ট পথ অতিক্রম করে, তেমনি নিষ্ক্রিয়, সচেতন ও বুদ্ধিমান পুরুষ এবং সক্রিয়, অচেতন ও অনুভূতিহীন প্রকৃতি উভয়ে একত্র হয়ে জগৎ-সৃষ্টিরূপ কার্য সম্পন্ন করে। সাংখ্য দার্শনিকগণ বলেন, প্রকৃতি ও পুরুষ তাদের মিলনের ফলে উভয়ে উভয়ের প্রয়োজনকে সিদ্ধ করে। পুরুষের প্রকৃতিকে প্রয়োজন ভিন্ন সত্তাকে জানার জন্য; নিজের ভোগের জন্য এবং নিজের মুক্তির জন্য। প্রকৃতি পুরুষের বন্ধনের কারণ, আর বন্ধন ব্যতীত মুক্তির প্রশ্নই উঠে না। পক্ষান্তরে, প্রকৃতিরও প্রয়োজন পুরুষ কর্তৃক দৃষ্ট ও ভোগ্য হওয়ার জন্য।
প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগ ঘটলে সাম্যাবস্থা ব্যাহত হয় এবং প্রকৃতির মধ্যে একটি তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়। রজোগুণ সম্ভবত চঞ্চল, তাই রজোগুণই প্রথমে সক্রিয় হয়ে উঠে এবং পরে সত্ত্ব ও তমোগুণের ক্রিয়া আরম্ভ হয়। প্রকৃতিস্থিত প্রত্যেকটি গুণ অপর গুণ দুটির উপর আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করে। ফলে নিম্নক্রমানুসারে জগতের অভিব্যক্তি ঘটে।
প্রকৃতির প্রথম পরিণাম মহৎ বা বুদ্ধি : প্রকৃতি হতে প্রথমে সৃষ্টি হয় মহৎ বা বুদ্ধির। প্রকৃতি সত্ত্বগুণের প্রাধান্যহেতু বুদ্ধির অভাব ঘটে। বুদ্ধি নিজেকে যেমন প্রকাশ করে তেমনি অন্যকেও প্রকাশ করে। পুরুষের চৈতন্য বুদ্ধিতে প্রতিবিম্বিত হয় বলে বুদ্ধিকেও সচেতন বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে বুদ্ধি পুরুষও নয়, আর সচেতনও নয়।
প্রকৃতির দ্বিতীয় পরিণাম অহংকার : মহৎ হতে সৃষ্টি হয় অহঙ্কারের। অভিমানই (selfhood) অহংকারের বৈশিষ্ট্য, অহম অর্থাৎ ‘আমি’ এবং মম অর্থাৎ ‘আমার’ এ দুটি বোধ অহংকারের প্রধান লক্ষণ। এ অহংকারের জন্যই নিষ্ক্রিয় পুরুষ বা আত্মা নিজেকে কর্তা বলে মনে করে এবং প্রিয় বস্তুকে লাভ করার ও অপ্রিয়কে বর্জনের চেষ্টা করে। ফলে পুরুষ সুখ ও
দুঃখ ভোগ করে। সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের প্রাধান্য অনুসারে অহংকার তিন প্রকার। যথা :
(১) সাত্ত্বিক বা বৈকারিক;
(২) রাজস বা তৈজস ও
(৩) তামস বা ভূতাদি ।
সত্ত্বগুণের আধিক্য ঘটলে সাত্ত্বিক, রজোগুণের আধিক্য ঘটলে রাজস এবং তমোগুণের আধিক্য ঘটলে তামস অহংকারের সৃষ্টি হয়। সাত্ত্বিক অহংকার হতে পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় (যথা : চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক), পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় (যথা: হাত, পা, পায়ু বা গুহ্যদ্বার, মুখ ও উপস্থ বা জননেন্দ্রিয়) ও মন এর আবির্ভাব হয়। তামস অহংকার হতে উদ্ভব হয়। পঞ্চতন্মাত্রের (রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দ)। রাজস অহংকারের কাজ হলো সাত্ত্বিক ও তামস এ দুই অহংকারকে শক্তি প্রদান করে তাদের অভিব্যক্তিকে সাহায্য করা।
সাংখ্য দর্শন মতে, পঞ্চতন্মাত্র হতে সৃষ্টি হয় পঞ্চমহাভূতের (যথা : ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম)। এপঞ্চ মহাভূতের অভিব্যক্তি হলো নিম্নরূপ :
১. শব্দ তন্মাত্র হতে ব্যোম বা আকাশের উৎপত্তি হয়।
২. শব্দ তন্মাত্র এবং স্পর্শ তম্মাত্রের সংযোগের ফলে মরুৎ বা বায়ুর উৎপত্তি হয়।
৩. শব্দ তন্মাত্র ও স্পর্শ তম্মাত্রের সঙ্গে রূপ তম্মাত্রের সংযোগের ফলে স্পর্শ-রূপ-গুণযুক্ত ‘তেজের’ উৎপত্তি হয়।
৪. শব্দ-স্পর্শ-রূপ তম্মাত্রের সঙ্গে রস তম্মাত্রের সংযোগের ফলে শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস গুণযুক্ত অপ বা জলের উৎপত্তি হয়।
৫. শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস তম্মাত্রের সঙ্গে গন্ধ তন্মাত্রের সংযোগ ঘটলে শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস গন্ধগুণ বিশিষ্ট ক্ষিতি বা পৃথিবীর উৎপত্তি হয়।
প্রকৃতি হতে মহাভূত পর্যন্ত প্রকৃতির পরিণামগুলোকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
১. প্রত্যয় সর্গ বা বুদ্ধি সর্গ বা প্রত্যয়গত বিবর্তন ও
২. তন্মাত্র সর্গ বা ভৌতিক সর্গ বা তন্মাত্রগত বিবর্তন।
মহৎ, অহংকার, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় এবং উভয়েন্দ্রিয় মন এ তেরোটি পরিণামকে প্রত্যয় সর্গ বলা হয়। আর পঞ্চতন্মাত্র, পঞ্চমহাভূত এবং মহাভূত হতে উৎপন্ন সকল দ্রব্য তন্মাত্র সর্গের অন্তর্ভুক্ত। পুরুষ-সান্নিধ্য প্রকৃতির অভিব্যক্তিকে নিম্নে ছকের সাহায্যে দেখানো হলো :
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, সাংখ্য মতে পুরুষ ও প্রকৃতি তাদের মিলনের ফলে উভয়ে উভয়ের প্রয়োজনকে সিদ্ধ করে। পুরুষের প্রকৃতিকে প্রয়োজন ভিন্ন সত্তাকে জানার জন্য; নিজের ভোগের জন্য এবং নিজের মুক্তির জন্য। প্রকৃতি পুরুষের বন্ধনের কারণ আর বন্ধন ব্যতীত মুক্তির প্রশ্নই উঠে না। পক্ষান্তরে, প্রকৃতিরও প্রয়োজন পুরুষ কর্তৃক দৃষ্ট ও ভোগ্য হওয়ার জন্য। সুতরাং প্রকৃতির কর্মক্ষমতা ও পুরুষের বুদ্ধি এ দু
টোর যখন সংযোগ হয় তখন জগতের অভিব্যক্তি বা বিবর্তন আরম্ভ হয়।