অথবা, সাংখ্য দর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষের যুক্তিগুলো লিখ।
অথবা, ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষের যুক্তিগুলো কী কী?
অথবা, সাংখ্য দর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষের প্রমাণগুলো কী কী?
উত্তর৷ ভূমিকা : সাংখ্য দর্শন ভারতীয় দর্শনের প্রাচীনতম চিন্তাধারার মধ্যে অন্যতম। মহর্ষি কপিলদেব সাংখ্য দর্শনের প্রবর্তক ও প্রতিষ্ঠাতা। সাংখ্যসূত্রে মহর্ষি কপিল ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না।
নিম্নে সাংখ্য ঈশ্বরতত্ত্ব আলোচনা করা হলো :
সাংখ্য ঈশ্বরতত্ত্ব : ঈশ্বর সম্পর্কে সাংখ্য দর্শনের ভাষ্যকার ও ব্যাখ্যাকারদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়। কোন কোন ভাষ্যকার সাংখ্য দর্শনকে নিরীশ্বরবাদী দর্শন বলেছেন। আবার কোন কোন ভাষ্যকারের মতে, সাংখ্য দর্শন ন্যায় বৈশেষিক দর্শনের মতো ঈশ্বরবাদী দর্শন। প্রাচীন সাংখ্য দার্শনিকগণ সাংখ্য দর্শনকে নিরীশ্বর সাংখ্য এবং যোগদর্শনকে সেশ্বর সাংখ্য নামে অভিহিত করেছেন। তাঁরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিপক্ষে কতকগুলো যুক্তি দিয়েছেন। যুক্তিগুলো হলো :
১. জগৎ যেহেতু কার্য সেহেতু জগতের নিশ্চয় একটি কারণ আছে। ঈশ্বরকে এ জগতের কারণ বলে অনুমান করা হয়। কিন্তু ঈশ্বর জগতের কারণ হতে পারে না। যেহেতু তাঁকে নিত্য, অপরিণামী, নির্বিকার ইত্যাদি বলা হয়। যার কোন বিকার বা পরিবর্তন নেই তা কখনো কোন কিছুর কারণ হতে পারে না। নিত্য অথচ পরিণামী প্রকৃতিই জগতের মূল কারণ।
২. প্রকৃতি জড় ও অচেতন। কাজেই তাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এক চেতন সত্তার প্রয়োজন এবং সেই চেতন সত্তাই ঈশ্বর বলে অনুমান করা হয় । কিন্তু ঈশ্বরবাদীদের বর্ণনা অনুসারে ঈশ্বর সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। অথচ নিয়ন্ত্রণ করা এক রকমের ক্রিয়া। সুতরাং ঈশ্বর নিষ্ক্রিয় বলে প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণকর্তা হতে পারে না।
৩. তর্কের খাতিরে যদি মেনে নেয়া হয় যে, ঈশ্বর প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণকারী, তখন প্রশ্ন আসে কেন ঈশ্বর প্রকৃতির জগৎ সৃষ্টিরূপ কর্মের নিয়ন্ত্রণ করেন? কোন কর্ম সম্পাদনে কর্মকর্তার একটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় ঈশ্বর তাঁর এ পরিচালনারূপ কর্মের দ্বারা কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে। যেহেতু ঈশ্বর স্বয়ংসম্পূর্ণ তাঁর কোন উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন থাকতে পারে না। এসব প্রশ্নের কোন যুক্তিসঙ্গত উত্তর নেই। দ্বিতীয়ত, করুণাবশত ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টিরূপ কর্মের পরিচালনা করতে পারেন না। কারণ সৃষ্টির প্রথম অবস্থায় করুণা দেখাবার মতো কোন জীব ছিল না। আর করুণাবশত তিনি জগতে এত দুঃখ-কষ্ট সৃষ্টি করেন কেমন করে? সুতরাং ঈশ্বরের অস্তিত্বের অনুমান যুক্তিসঙ্গত নয়।
৪. ঈশ্বরের ধারণা এবং জীবাত্মার নিত্যতা ও স্বাতন্ত্র্যের ধারণার মধ্যে কোন সঙ্গতি নেই। কারণ ঈশ্বর যদি জগৎ এবং জগতের সবকিছুরই স্রষ্টা হন তবে জীবাত্মাও তার সৃষ্টি। যেহেতু সকল সৃষ্ট জিনিসই ধ্বংসশীল, সেহেতু জীবাত্মাও ধ্বংসশীল । তাই যদি হয় তবে জীবাত্মা নিত্য হয় কেমন করে, আবার ঈশ্বর যদি সর্বভূতস্থ হন এবং জীব যদি ঈশ্বরের অংশ হয় তবে জীবাত্মাকে স্বতন্ত্র বলা যায় না। সুতরাং জীবাত্মার নিত্যতা ও স্বাতন্ত্র্য ঈশ্বরের নাস্তিত্বই প্রমাণ করে।
৫. প্রাচীন সাংখ্য দার্শনিকগণ আরো বলেন, শ্রুতিতে যে ঈশ্বরের উল্লেখ আছে তা মুক্ত পুরুষদের ঈশ্বর বলে প্রশংসা করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
৬. প্রাচীন সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, কর্মফলদাতারূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকারের কোন প্রয়োজন নেই । তাঁরা বলেন, কর্ম স্বাভাবিকভাবে তার ফল প্রদান করতে পারে, কোন বহিঃশক্তির প্রযোজন হয় না। সুতরাং কর্মফল নিষ্পত্তির জন্য ঈশ্বরের অধিষ্ঠানের কোন প্রয়োজন হয় না।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, বিজ্ঞানভিক্ষু প্রকৃতিকে জগৎ সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করার কর্তারূপে ঈশ্বরের অস্তিত্বের অনুমান যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করেন। কিন্তু বিজ্ঞান
ভিক্ষুর মর্তবাদ খুব বেশি মানুষের কাছে স্বীকৃতি লাভ করে নি। প্রায় – সকলেই সাংখ্য দর্শনকে নিরীশ্বরবাদী দর্শন বলে মনে করেন।