অথবা, প্রত্যক্ষ সম্পর্কে সাংখ্য অভিমত ব্যাখ্যা কর।
অথবা, সাংখ্য দর্শনে প্রত্যক্ষ কত প্রকার ও কী কী?
অথবা, সাংখ্য দর্শনের প্রকারভেদ লিখ।
অথবা, সাংখ্য দর্শনের শ্রেণিবিন্যাস কর।
উত্তরা৷ ভূমিকা : জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনায় সাংখ্য দর্শনে তিনটি প্রমাণ স্বীকৃত হয়েছে। যথা : প্রত্যক্ষ (Perception), অনুমান (Inference) ও শব্দ (Testimony)। উপমান (Comparison), অর্থাপত্তি (Postulation), অনুপলব্ধি (Non-Cognition) প্রভৃতি অন্যান্য প্রমাণগুলো এ তিনটি প্রমাণের অন্তর্ভুক্ত বলে সাংখ্য দার্শনিকগণ এদের স্বতন্ত্র প্রমাণ বলে স্বীকার করেন নি।
প্রত্যক্ষ (Perception) : সাংখ্য স্বীকৃত প্রমাণগুলোর মধ্যে ‘প্রত্যক্ষই’ প্রথম প্রমাণ। বিষয়ের সাথে ইন্দ্রিয়ের সংযোগের সাথে যে সাক্ষাৎ জ্ঞানের উদ্ভব হয়, তাকে ‘প্রত্যক্ষ জ্ঞান’ বলা হয়। যেমন : যখন একটি আম আমার চোখের সামনে থাকে এবং আমটি ও আমার চোখের মাঝখানে বাধা সৃষ্টিকারী কোন বস্তু না থাকে তখন আমটি সম্পর্কে আমার প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ হয়। আমটি আমার চোখের মধ্যে একপ্রকার আলোড়নের অর্থাৎ সংবেদনের সৃষ্টি করে। মন সে আলোড়ন বা সংবেদনকে ব্যাখ্যা করে। ইন্দ্রিয় এবং মনের এ সক্রিয়তার ফলে বুদ্ধি বিষয়াকার ধারণ করে। বুদ্ধি অচেতন বলে সে আমটিকে জানতে পারে না। বুদ্ধির বৃত্তিতে সত্ত্বগুণের আধিক্যের জন্য এটা দর্পণের মতো স্বচ্ছ হয় এবং এতে পুরুষের চৈতন্য প্রতিবিম্ব হয়। ফলে বুদ্ধিবৃত্তি চেতনা-ভাবাপন্ন হয় এবং আম সম্পর্কে তখন প্রত্যক্ষ জ্ঞান জন্মে।
প্রত্যক্ষের ভাগ : প্রত্যক্ষকে প্রথমে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা :
১. লৌকিক এবং ২. অলৌকিক।
১. লৌকিক প্রত্যক্ষ : চোখ, কান প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে প্রত্যক্ষ করা হয়, তাকে লৌকিক বা বাহ্য প্রত্যক্ষ বলা হয়। লৌকিক প্রত্যক্ষ বা বাহ্য প্রত্যক্ষকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা : ক. নির্বিকল্প (Indeterminate) এবং খ. সবিকল্প (Determinate)।
ক. নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ : যে প্রত্যক্ষ বস্তুর কেবল অস্তিত্ব সম্পর্কে জ্ঞান হয়, তাকে নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ বলা হয়। নির্বিকল্প প্রত্যক্ষে বস্তুর কোন বৈশিষ্ট্যকে জানা হয় না। অর্থাৎ বস্তুটি কি রকমের, এর জাতি বা নাম কি, এর সংজ্ঞা কি ইত্যাদি সম্পর্কে কোন জ্ঞান নির্বিকল্প প্রত্যক্ষে থাকে না। নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ জ্ঞান বস্তু সম্পর্কে অপরিস্ফুট জ্ঞান। যেমন- একটি পদ্ম
ফুলের সাথে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হওয়া মাত্রই পদ্ম ফুলটি যে একটি বস্তু সে জ্ঞানটি হয়। বস্তুটি যে পদ্ম ফুল, তার যে লাল
রং, এসব সম্পর্কে কোন জ্ঞান হয় না। সুতরাং পদ্ম ফুলটি সম্পর্কে এ জাতীয় জ্ঞান নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ জ্ঞান।
খ. সবিকল্প : যে প্রত্যক্ষ বস্তুর নাম, লক্ষণ, জাতি প্রভৃতি যাবতীয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট জ্ঞান লাভ হয়, তাকে সবিকল্প প্রত্যক্ষ বলে। সবিকল্প প্রত্যক্ষে বিশ্লেষণ, সাদৃশ্য, তুলনা প্রভৃতি মানসিক প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে বস্তু সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান লাভ করা হয়। যেমন : পদ্ম ফুল নামক বস্তুটিকে প্রত্যক্ষ করে যদি জ্ঞান হয় যে, বস্তুটি পদ্ম ফুল। তার রং
লাল, তা ফুটন্ত ইত্যাদি, তবে ঐ প্রত্যক্ষ হবে সবিকল্প প্রত্যক্ষ। নির্বিকল্পের পরিণতি হলো সবিকল্প।
২. অলৌকিক প্রত্যক্ষ : যোগ-সাধনালব্ধ অলৌকিক শক্তির বলে যোগীরা যখন অতি সূক্ষ্ম, অতীত এবং ভবিষ্যতের বস্তুকে প্রত্যক্ষ করে তখন তাকে অলৌকিক প্রত্যক্ষ বলা হয় ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সাংখ্য জ্ঞানতত্ত্ব নিজস্ব অস্তিত্বের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এবং ভিন্নধর্মী কিছু আলোচনার প্রয়াস পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা নৈয়ায়িকদের মতকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে সাংখ্য দর্শন এক নিজস্ব গতিময়তার দিকে ধাবমান হয়েছে তার এ গতিময়তা থেকেই উৎপত
্তি লাভ করেছে তাদের বহুল আলোচিত জ্ঞানতত্ত্ব বিষয়ক মতবাদ। তাইতো ভারতীয় দর্শনে সাংখ্য জ্ঞানতত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।