বৌদ্ধদর্শনের কর্মবাদ আলোচনা কর।

অথবা, গৌতম বুদ্ধের নৈতিক উপদেশাবলির অন্তর্নিহিত দার্শনিক তত্ত্ব হিসেবে কর্মবাদ আলোচনা কর।
অথবা, বৌদ্ধ দর্শনের কর্মবাদ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, কর্মবাদ সম্পর্কে বৌদ্ধ দার্শনিকদের অভিমত বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে হিমালয়ের পাদদেশে কপিলাবস্তু নগরে এক রাজ পরিবারে গৌতম বুদ্ধের জন্ম। তাঁর পূর্ব নাম ছিল গৌতম বা সিদ্ধার্থ। তিনি নিজ আত্মশক্তির উপর বিশ্বাস রেখে বহু বছর কঠোর তপস্যা করে জগতের দুঃখের রহস্য ও স্বরূপ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন এবং বুদ্ধত্ব লাভ করেন। গৌতম বুদ্ধের বাণী তাঁর তিন জন প্রিয় শিষ্য পালি ভাষায় তিন গ্রন্থের আকারে লিপিবদ্ধ করেন। এ তিনটি গ্রন্থ ‘ত্রিপিটক’ নামে পরিচিত। এ ত্রিপিটক, গ্রন্থে বৌদ্ধদর্শনের বা বৌদ্ধধর্মের সমুদয় লিপিবদ্ধ আছে। নৈতিক উপদেশই ছিল বুদ্ধের শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য। তাঁর নৈতিক শিক্ষার মূলে চারটি দার্শনিক তত্ত্ব রয়েছে। এ চারটি তত্ত্ব হলো প্রতীত্য সমুৎপাদ বা শর্তাধীন সৃষ্টিবাদ, কর্মবাদ, সর্বব্যাপক পরিবর্তনবাদ বা অনিত্যবাদ এবং অনাত্মবাদ। নিম্নে প্রশ্নপত্রের আলোকে বৌদ্ধদর্শনের কর্মবাদ আলোচনা করা হলো :
বৌদ্ধদর্শনের কর্মবাদ : কর্মবাদ প্রতীত্য সমুৎপাদ বা শর্তাধীন সৃষ্টিবাদের একটি বিশেষ প্রকাশ মাত্র। কর্মবাদ অনুসারে মানুষকে তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করতেই হবে এবং যে যেমন কর্ম করবে সে তেমন ফল ভোগ করবে।
কর্মবাদ অনুযায়ী মানুষের বর্তমান অবস্থা তার পূর্ববর্তী কর্মেরই পরিণতি এবং বর্তমান কর্মের পরিণতি হবে ভবিষ্যতের অবস্থা। এ কর্ম নিয়ম অতি প্রাচীন নিয়ম, বেদেও কর্ম নিয়মের উল্লেখ আছে। এ নিয়মকে লঙ্ঘন করা যায় না। S. Chatterjee and D. Datta তাদের ‘An Introduction to Indian Philosophy’ গ্রন্থে বলেন, “The law of karma is only a special form of the more general law of causation as conceived by Buddha.”
(Page-135)
কর্মবাদ প্রতীত্য সমুৎপাদবাদের রূপান্তর : প্রতীত্য সমুৎপাদ নিয়ম অনুসারে প্রতিটি বস্তু বা ঘটনার কারণ আছে। সুতরাং মানুষের বর্তমান জীবনেরও একটি কারণ আছে। বুদ্ধদেবের মতে, সে কারণটি হলো মানুষের প্রাক্তন জীবনের কর্ম। প্রতীত্য সমুৎপাদ নিয়ম অনুসারে বর্তমান জীবনও একটি কার্য সৃষ্টি না করে নিঃশেষে বিনষ্ট হতে পারে না এবং বর্তমান জীবন যে কার্যটির সৃষ্টি করবে তা হবে ‘পরজন্ম’। মানুষের পূর্বজন্ম, বর্তমান জীবন এবং পরজন্ম-এ তিনটির মধ্যে যে যোগসূত্রটি আছে তা হলো তার কৃতকর্ম। বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেন এবং গ্রিকরাজা মিলিন্দের কথোপকথনে নাগসেনের একটি উক্তি আছে যে, সকল মানুষ একরকম না হওয়ার কারণ হলো তার কৃতকর্ম। বিভিন্ন মানুষের কর্মের পার্থক্য আছে বলেই মানুষের মধ্যে কেউ সুন্দর, কেউ কুৎসিত, কেউ সুস্থ্য, কেউ রুগ্ন ইত্যাদি পার্থক্য দেখা যায়। বৌদ্ধ মতে, কর্মফলের ভোগ শেষ না হলে তা পরজন্মের জন্য সঞ্চিত থাকে, কিন্তু বিনষ্ট হয় না।
কর্মের প্রকারভেদ : বুদ্ধদেবের মতে, কর্ম দুই প্রকারের; যথা : সকাম এবং নিষ্কাম। বাসনাজাত মোহযুক্ত কর্ম হলো সকাম কর্ম, আর বাসনাহীন এবং মোহযুক্ত কর্ম হলো নিষ্কাম কর্ম। মানুষের নির্বাণ লাভের পর যে কর্ম করা হয় তা নিষ্কাম কর্ম। বুদ্ধদেব বলেছেন, আগুনে ভাজা বীজ রোপন করলে যেমন কোন ফলোৎপাদন হয় না, তেমনি নিষ্কাম কর্মও ফলপ্রসূ হয় না। কেবল সকাম কর্মই মানুষকে জন্ম হতে জন্মান্তরে চক্রের মতো ঘুরায়।
কর্মবাদ ও ইচ্ছার স্বাধীনতা : বুদ্ধদেব মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেন নি, বরং মানুষ যে ইচ্ছার স্বাধীনতার দ্বারা তার কর্মের গতি ফিরিয়ে কর্মফলে রূপান্তরের সৃষ্টি করতে পারে তা তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেছেন। বুদ্ধদেবের মতে কর্ম নিয়ম যান্ত্রিক নিয়ম নয়। এ নিয়ম স্বীকার করে যে, অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এ তিনটির মধ্যে ধারাবাহিকতা আছে। কিন্তু এ নিয়মের দ্বারা এই কথা বুঝায় না যে, মানুষ ইচ্ছা করলে তার বর্তমান অবস্থার রূপান্তর ঘটাতে পারতো না। বুদ্ধদেব বলেন, মানুষ ইচ্ছা করলে তার পূর্বকর্মের রূপের পরিবর্তন করে বর্তমান অবস্থার রূপান্তর ঘটাতে পারে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি, নৈতিক শিক্ষায় বুদ্ধদেবের দার্শনিক তত্ত্বসমূহের মধ্যে কর্মবাদ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। গৌতম বুদ্ধের নৈতিক শিক্ষার দার্শনিকতত্ত্ব হিসেবে কর্মবাদ ব্যাপক সাড়া জাগায়। তাঁর দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে অচিরেই বৌদ্ধধর্ম, সিংহল, শ্যাম, ব্রহ্মদেশ, তিব্বত, কোরিয়া, চিন, জাপান প্রভৃতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তার লাভ করে এবং বৌদ্ধধর্ম বা বৌদ্ধদর্শন আজও পৃথিবীর বুকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বদর্পে দাঁড়িয়ে আছে।