অথবা, বৌদ্ধ দর্শন দ্বারা বাংলাদেশের দর্শন কীভাবে প্রভাবিত?
অথবা, বৌদ্ধ দর্শনের দ্বারা বাংলাদেশের দার্শনিকবৃন্দ কীভাবে প্রভাবিত হয়েছেন তা সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে হিমালয়ের পাদদেশে কপিলাবস্তু নগরে এক রাজপরিবারে গৌতম বুদ্ধের জন্ম। রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও গৌতম বুদ্ধ বাল্যকাল থেকেই চিন্তাশীল এবং বৈরাগ্যভাবাপন্ন ছিলেন। তিনি নিজের আত্মশক্তির উপর বিশ্বাস রেখে বহু বছর কঠোর তপস্যা করে জগতে দুঃখের রহস্য ও স্বরূপ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেন। গৌতম বুদ্ধের বাণী এবং উপদেশের উপর ভিত্তি করে যে দর্শন তাই বৌদ্ধ দর্শন।
বাংলাদেশের দার্শনিক ঐতিহ্যে প্রভাব : বাংলাদেশের দার্শনিক ঐতিহ্যে বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাব অবিস্মরণীয়। বৌদ্ধ দর্শনের উৎপত্তিকাল থেকে শুরু করে অদ্যাবধি এর প্রভাব জনজীবনে বিশেষ করে বাঙালির জীবনধারায় অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। বৌদ্ধরা দ্বিতীয় প্রধান সংখ্যালঘু : ধর্মনিরপেক্ষতা বাংলাদেশের একটি অন্যতম মূলনীতি। বিভিন্ন ধর্মের, বর্ণের লোক বাংলার মাটির টানে এখানে বাস করছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৌদ্ধ মঠ সংঘারাম, বৌদ্ধবিহার, মহাবিহার আজও গর্বের সাথে মাথা সমুন্নত রেখে বৌদ্ধ ঐতিহ্যের ধারা অব্যাহত রেখেছে। আজও বাংলাদেশের বৌদ্ধরা দ্বিতীয় প্রধান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়।
বাংলায় বৌদ্ধ দর্শনের প্রবেশ : প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধ দর্শন বাংলার মাটিতে কখন প্রবেশ লাভ করে এ সম্পর্কে সঠিক সন, তারিখ উল্লেখ করা না গেলেও সম্ভবত রাজা অশোকের আগেই উত্তর বাংলায় বৌদ্ধ দর্শনের সম্প্রসারণ ঘটে।
বৌদ্ধ দর্শনের জনপ্রিয়তা লাভ : খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের পর থেকে শুরু করে বাঙালির চিন্তা-চেতনায় বৌদ্ধধর্মের আদর্শ একটি সম্মানজনক স্থান লাভে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বুদ্ধের শিষ্যগণ অত্যন্ত সরল ভাষায় তাঁর বক্তব্য সকলের নিকট পৌঁছাতে থাকেন।
বাঙালির ঐতিহ্য উপলব্ধি : বৌদ্ধগণ তাঁদের ধর্ম ও দর্শন মাতৃভাষায় প্রচার করেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সংস্কৃত শব্দ গ্রহণ করলেও সংস্কৃত ভাষা কোন চাপের মুখে তারা গ্রহণ করেন নি। বুদ্ধের মাধ্যমে মানুষ তার নিজের ঐতিহ্য ও মর্যাদা উপলব্ধি করতে শুরু করে।
শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে প্রভাব : বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ক্রমে এত শক্তিশালী হয়ে উঠে যে, আর্যদের পিছু হটিয়ে পাটলীপুত্র বৌদ্ধদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হয়ে উঠে এবং দুই এক শতকের মধ্যেই বৌদ্ধ রাজারা সমগ্র বাংলায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। তাদের পৃষ্ঠ-পোষকতায় বৌদ্ধ দর্শন দারুণভাবে শিক্ষা সংস্কৃতিতে প্রভাব বিস্তার করে।
বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাবের নমুনা : বাংলায় বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাবের নমুনা আমরা দেখতে পাই বাংলার সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে লোক সংস্কৃতিতে। লোক সংস্কৃতিতে বৌদ্ধদের শূন্যতা তত্ত্ব ব্যাপক প্রভাবের সাথে ছড়িয়ে পড়ে।
বজ্রযান ও চর্যাপদের উপর প্রভাব : বাংলাদেশের লোক সংস্কৃতিতে বজ্রযান অধিক প্রচলিত ছিল। গৌতম বুদ্ধের ক্রিকায়ার সঙ্গে এই মতবাদটি আরও একটি কায়া যুক্ত করে। এর নাম বজ্রকায়া। বাংলাদেশের লোকায়ত সংস্কৃতিতে বজ্রযানের পাশাপাশি মহাযানও প্রচলিত ছিল। চর্যাপদে বৌদ্ধ সহজিয়া মতের প্রচুর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, বৌদ্ধ যুগকে বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং সভ্যতার ক্ষেত্রে সুবর্ণ যুগ বলা চলে। বর্তমান বংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির গোড়াপত্তন হয়েছে এ যুগে। এই যুগ প্রথম বৃহত্তম সামাজিক সমীকরণ ও সমন্বয়ের যুগ। উনিশ শতকে বাঙালির নবজাগরণের পশ্চাতে পাশ্চাত্যের প্রভাবের সাথে সাথে স্থানীয় বৌদ্ধ ঐতিহ্যের প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না।