জৈন স্যাদবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।

অথবা, জৈন স্যাদবাদ ব্যাখ্যা কর। এ তত্ন কীভাবে ‘সন্তভঙ্গি নয়’ এর সাথে সম্পর্কিত?
অথবা, জৈন গ্যাদবাদ তত্ত্বের একটি সমালোচনামূলক ব্যাখ্যা দাও।
অথবা, জৈন স্যাদবাদ ও ‘সন্তভঙ্গি নয়’ মতবাদ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ কর।
অথবা, জৈন দর্শনে স্যাদবাদ তত্ত্বটি ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
জৈন দর্শন অতি প্রাচীন দর্শন। চব্বিশজন তীর্থঙ্কর জৈন দর্শনের প্রচারক। এ প্রচারকদের প্রথম জনের নাম ছিল ঋষভদেব এবং সর্বশেষ জনের নাম হলো বর্ধমান বা মহাবীর। এ মহানীরকে বস্তুত জৈনধর্ম ও দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা বলে সকলেই মনে করে। মহাবীরের জন্য খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। তিনি গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক। জৈনগণ নিরীশ্বরবাদী ছিলেন। তাদের সব আলোচনাতে নিরীশ্বরবাদী চিন্তাচেতনা প্রতিফলিত হয়েছে। তাদের বিভিন্ন আলোচ্যবিষয়ের মধ্যে স্যাদবাদ ও ‘সন্তভঙ্গী নয়’ আলোচনা বিশেষ এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
জৈন দর্শনের স্যাদবাদ ও ‘সন্তভঙ্গী নয়’ মতবাদ : জৈনগণের মতে, একটি বস্তুর অসংখ্য গুণ আছে। একমাত্র সর্বজ্ঞ মানুষ তার ‘কেবল জ্ঞান’ দ্বারা বস্তুর অসংখ্য গুণগুলোকে একসাথে জানতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষ
অসীম জীব বলে তাদের পক্ষে একসাথে সব গুণ জানা সম্ভব নয়। তাই যখন কোন সাধারণ মানুষ কোন বস্তুকে জানে, তখন সে বস্তুটির অসংখ্য গুণের মধ্যে যে কোন একটি বিশেষ গুণকে জানে। কোন বস্তুর অসংখ্য গুণের মধ্যে যে কোন একটি সম্পর্কে যে জ্ঞান তাকে জৈনগণ ‘নয়’ বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুর এ আংশিক জ্ঞানের মূলে যে অবধারণ তাকেও তারা ‘নয়’ বলেছেন। জৈনগণ বলেছেন, সাধারণ মানুষ দৈনন্দিন জীবনে কোন বস্তু সম্পর্কে যেসব অবধারণ রচনা করে সে অবধারণ কোন একটি দৃষ্টিভঙ্গি হতে ঐ বস্তুর কোন একটি গুণ সম্পর্কে সত্য হতে পারে, সর্বভাবে সত্য হতে পারে না। এ বিষয়টিকে ভালোভাবে বুঝানোর জন্য জৈন দার্শনিকগণ একটি দৃষ্টান্তের সাহায্য নিয়েছেন। চারজন অন্ধ একটি হস্তীর শরীরের চারটি অংশ স্পর্শ করে ঐ হস্তী সম্পর্কে চার প্রকার ধারণ লাভ করে। যে হস্তীর পা স্পর্শ করল সে বলল, হস্তী স্তম্ভের মতো; যে কান স্পর্শ করল সে বলল, হস্তী কুলার মতো; যে দাঁত স্পর্শ করল সে বলল, হস্তী সরু কলার মতো এবং যে পেট স্পর্শ করল সে বলল, হস্তী বিশাল এক পাহাড়। এদের প্রত্যেকেই মনে করল হস্তী সম্পর্কে তার ধারণা সত্য এবং অন্য তিনজনের ধারণা মিথ্যা। তাই তাদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হলো। যখনই তারা বুঝল যে, হস্তী সম্বন্ধে তাদের কারো ধারণা সম্পূর্ণ সত্য নয়। আবার সম্পূর্ণ মিথ্যাও নয়। তবে আংশিক সত্য, তখনই বিতর্কের অবসান হলো।
তাই জৈনগণ বলেছেন, কোন বস্তু সম্পর্কে কোন অবধারণ প্রকাশ করার সময় তাকে শর্তহীন না করে শর্তসহ করা উচিত। তাঁদের মতে, এ শর্ত হলো স্যাৎ। স্যাৎ শব্দের অর্থ হলো সম্ভবত। প্রতিটি অবধারণকে প্রকাশ করার সময় ‘স্যাৎ’ বিশেষণটি যোগ করে দেয়া উচিত। যেমন- ‘হস্তী কুলার মতো’ এ কথা না বলে ‘সম্ভবত হস্তী কুলার মতো’ এ কথা বলা উচিত। জৈনগণ বলেছেন, প্রতিটি অবধারণে যদি স্যাৎ শব্দটি থাকে তবে এটা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, অবধারণটি আংশিক সত্য এবং আলোচ্য বস্তু সম্পর্কে বিকল্প অবধারণও সত্য হতে পারে। জৈন দার্শনিকদের এ মতবাদের নামই স্যাদবাদ। স্যাদবাদ অনুসারে সসীম ও অপূর্ণ মানুষ কোন বস্তু সম্পর্কে যে অবধারণ রচনা করে সে অবধারণ বস্তুর কোন একটি দিক হতে সত্য অর্থাৎ এর সত্যতা শর্তাধীন; কিন্তু সর্বদিক হতে সত্য নয়। অর্থাৎ এর সত্যতা নিঃশর্ত নয়। এ সাত প্রকার ‘নয়’ এর প্রত্যেকটি যে আংশিক সত্য তা প্রমাণ করার জন্য জৈনগণ প্রত্যেকটি ‘নয়’ এর প্রারম্ভে স্যাৎ শব্দটি প্রয়োগ করেন। এ সাত প্রকার ‘নয়’কে জৈনগণ ‘সপ্তভঙ্গী নয়’ নামে অভিহিত করেন। জৈন মতে, যে কোন উদ্দেশ্য সম্পর্কে সাত প্রকার অবধারণ বা নয় রচনা করা যায় এবং তাদের সাধারণ রূপ নিম্নরূপ :
১. স্যাৎ অস্তি; ২. স্যাৎ নাস্তি; ৩. স্যাৎ অস্তি চ, নাস্তি চ; ৪. স্যাৎ অবক্তব্যম; ৫. স্যাৎ অস্তি চ অবক্তব্যম্ চ; ৬. স্যাৎ নাস্তি চ, অবক্তব্যম্ চ এবং ৭. স্যাৎ অস্তি চ, নাস্তি চ, অবক্তব্যম্ চ। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বুঝানো যেতে পারে। যেমন- ‘আম’ হলো উদ্দেশ্য। এর সাতটি অবধারণ রচনা করতে হবে। প্রথমত, সদর্থক অবধারণে আমের একটি গুণ স্বীকার করা হবে। যেমন- মিষ্টতা। এর তর্কবিজ্ঞানসম্মত বচন হবে, ‘আম হয় মিষ্ট’। কিন্তু জৈনরা আম হয় মিষ্ট একথা না বলে বলেছেন, ‘সম্ভবত আম হয় মিষ্ট’ (স্যাৎ অস্তি)। অর্থাৎ, কোন বিশেষ দেশে, কোন বিশেষ কালে এবং কোন বিশেষ অবস্থায় আম মিষ্ট। দ্বিতীয়ত, নঞর্থক অবধারণে মিষ্টতা গুণটিকে অস্বীকার করা হবে। এর তর্ক বিজ্ঞানসম্মত বচন হবে, ‘আম নয় মিষ্ট’। কিন্তু জৈন দার্শনিকগণ এ কথা না বলে বলেছেন, ‘সম্ভবত আম নয় মিষ্ট’ (স্যাৎ নাস্তি)। অর্থাৎ কোন বিশেষ দেশে কোন বিশেষ কালে এবং কোন বিশেষ অবস্থায় আম মিষ্ট নয়। তৃতীয়ত, কোন এক দেশে কোন এক কালে এবং কোন এক অবস্থায় আম যদি মিষ্ট হয় এবং ভিন্ন দেশে ভিন্ন কালে এবং ভিন্ন অবস্থায় আম যদি মিষ্ট না হয় তবে জৈনরা এ উভয় সত্যকে প্রকাশ করার জন্য বলবেন, সম্ভবত আম মিষ্ট এবং মিষ্ট নয়’ (স্যাৎ অস্তি চ, নাস্তি চ)। চতুর্থত, কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে, সর্বদেশে, সর্বকালে এবং সর্বাবস্থায় আমের গুণ কি হবে? এ প্রশ্নের জবাবে বলতে হয়, ‘এটা বলা যায় না।’ আর জৈনরা বলবেন, ‘সম্ভবত এটা অব্যক্ত’ (স্যাৎ অবক্তব্যম্)। জৈন মতে, এটাই অবধারণের চতুর্থ রূপ । পঞ্চমত, প্রথম অবধারণের সাথে চতুর্থ অবধারণ যোগ করলে পঞ্চম অবধারণটি পাওয়া যায়। যেমন- কোন এক বিশেষ দেশে, বিশেষ কালে এবং বিশেষ অবস্থায় আম হয় মিষ্টি এবং সর্বদেশে, সর্বকালে ও সর্বাবস্থায় আম অবর্ণনীয়। একে প্রকাশ করতে হলে জৈনরা বলবেন, ‘সম্ভবত আম হয় মিষ্টি এবং অবক্তব্য’ (স্যাৎ অস্তি চ, অবক্তব্যম্ চ)। ষষ্ঠত, দ্বিতীয় অবধারণের সাথে চতুর্থ অবধারণ যোগ করলে ষষ্ঠ অবধারণটি পাওয়া যায়। যেমন- কোন এক বিশেষ দেশে, বিশেষ কালে ও বিশেষ অবস্থায় আম মিষ্টি নয় এবং সর্বদেশে, সর্বকালে ও সর্বাবস্থায় আম অবর্ণনীয়। একে প্রকাশ করতে হলে জৈনরা বলবেন, ‘সম্ভবত আম নয় মিষ্টি এবং অবক্তব্য’ (স্যাৎ নাস্তি চ, অবক্তব্যম চ)। সপ্তমত, আর তৃতীয় অবধারণের সাথে চতুর্থ অবধারণ যোগ করলে পঞ্চম অবধারণটি পাওয়া যাবে। যেমন- আম কোন এক বিশেষ দেশে, বিশেষ কালে ও বিশেষ অবস্থায় এবং ভিন্ন দেশে, ভিন্ন কালে ও ভিন্ন অবস্থায় মিষ্টি নয় এবং সর্বদেশে, সর্বকালে ও সর্বাবস্থায় অবর্ণনীয়। একে প্রকাশ করতে হলে জৈনরা বলবেন, ‘সম্ভবত আম মিষ্টি এবং মিষ্টি নয়
এবং অবক্তব্য’ (স্যাৎ অস্তি চ, নাস্তি চ, অবক্তব্যম্ চ)। জৈন মতে, কোন উদ্দেশ্য সম্পর্কে উপর্যুক্ত সাতটি অবধারণ ছাড়া আর বেশি কোন অবধারণ হতেই পারে না।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, যদিও বৌদ্ধ ও বৈদান্তিকগণ কঠোর ভাষায় জৈনদের স্যাদবাদ সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে, স্যাদবাদ উম্মাদের প্রলাপমাত্র। কারণ এ স্যাদবাদের সাহায্যে জৈনগণ বস্তুর সত্তা ও অসত্তা, একত্ব ও বহুত্ব, ভেদ ও অভেদ, সামান্য ও বিশেষ প্রভৃতি বিরুদ্ধ ধর্মের সমন্বয় করতে চেয়েছেন। এসব বিরোধী ধর্ম আলোক ও অন্ধকারেরই মতো একই অধিকরণে থাকতে পারে না। বিভিন্ন সমালোচনা সত্ত্বেও জৈন স্যাদবাদ বাস্তব ও অলৌকিক দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিচায়ক।