অথবা, জীব বা আত্মার বন্ধন বলতে কী বুঝ? কীভাবে জীব বা আত্মার বন্ধন হতে মুক্তি সম্ভব? আলোচনা কর ।
অথবা, জৈন নীতিশাস্ত্র সম্পর্কে আলোচনা কর।
অথবা, জৈনদের ত্রিরতা সম্পর্কে আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : জৈন দর্শনের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো নীতিশাস্ত্র। নীতিশাস্ত্র আলোচনা করতে গিয়ে জৈন দার্শনিকরা জীবের বন্ধন এবং সে বন্ধন হতে কিভাবে মুক্তিলাভ করা যায় তা আলোচনা করেছেন। আবার এ মুক্তিলাভের জন্য প্রয়োজন সম্যক চরিত্র গঠনের। মোক্ষলাভ বলতে জৈনগণ একদিকে যেমন বন্ধন হতে মুক্তিকে বুঝেছেন, অন্যদিকে তেমনি পূর্ণতালাভকেও বুঝিয়েছেন। জৈন মতে, বন্ধন হতে মুক্তি এবং পূর্ণতালাভই মানুষের জীবনের পরম পুরুষার্থ।
জৈন দর্শনের নীতিবিদ্যা সম্পর্কিত এসব আলোচনা নিম্নে আলোচিত হলো :
জীব বা আত্মার বন্ধন : জৈন মতে, চেতনাসম্পন্ন দ্রব্যই জীব। অর্থাৎ অন্যান্য ভারতীয় দর্শন যাকে আত্মা বলেছেন, জৈনগণ তাকে জীব বলেছেন। এ জীব বা আত্মা সম্ভবত পূর্ণ এবং অনন্ত জ্ঞান, অসীম শক্তি ও অফুরন্ত আনন্দের অধিকারী। কিন্তু জীবের এসব ঐশ্বর্য বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অপ্রকাশিত থাকে। মেঘ বা কুয়াশামুক্ত হয়ে সূর্য যেমন তার আলোকে বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে পারে, তেমনি এ জীব বা আত্মা বাধামুক্ত হলে আত্মস্থিত সর্বজ্ঞতা, সর্বশক্তিমত্তা এবং অফুরন্ত আনন্দকে বিকশিত করতে পারে।
জৈন মতে, জীবের পূর্ণতালাভের প্রধান বাধা হলো পুগল সৃষ্ট দেহ। তাঁদের মতে, পূর্বজন্মার্জিত কর্মফল ভোগ করার জন্য জীব জগতে জন্মগ্রহণ করে এবং তার দেহ গঠিত হয় কমোপযোগী পুদ্গল পরমাণুর দ্বারা। জৈন মতে, বিভিন্ন দেহ বিভিন্ন রকমের পুগল পরমাণুর দ্বারা সৃষ্ট এবং পুগল পরমাণুর বিন্যাসও বিভিন্ন দেহে নির্ভর করে জীবের কামনা বাসনার উপর। যেহেতু বিভিন্ন জীবের কামনা বাসনা বিভিন্ন রকমের, সেহেতু বিভিন্ন জীবদেহের পুগল পরমাণুর বিন্যাসও বিভিন্ন রকমের। উপর্যুক্ত কারণে জৈনরা জীবের কামনা বাসনাকে জীবদেহের ‘নিমিত্ত কারণ’ এবং পুগল পরমাণুকে জীবদেহের ‘উপাদান কারণ’ বলেছেন। জীব বা আত্মা জীবদেহে পরিব্যাপ্ত থাকে বলে দেহ গঠনকারী পুগল পরমাণুর প্রলেপ তার উপর পড়ে। ফলে আত্মার অন্তর্নিহিত পূর্ণতা ঢাকা পড়ে। জৈনগণ চারটি ভাবের উল্লেখ করেছেন। যথা : ক্রোধ, মান, মায়া এবং লোভ। এ ভাবগুলোকে ‘ক্যায়’ বলা হয়। তাঁদের মতে, এ ভাবগুলো আত্মার বন্ধনের প্রাথমিক কারণ। যেহেতু এরা আত্মায় পুদ্গল-পরমাণু প্রলিপ্ত করে।
জৈন মতে, বন্ধন দুই প্রকার। যথা : ভাববন্ধন এবং দ্রব্যবন্ধন। আত্মাস্থিত কুভাবনার যে বন্ধন তাকে ‘ভাববন্ধন’; আর এ কুভাবনার ফল পুগলের দ্বারা দেহের সাথে আত্মার সংযুক্তি রূপ বন্ধনকে ‘দ্রব্যবন্ধন’ বলা হয়।
জীব বা আত্মার মুক্তি : জৈনগণ বলেছেন, কামনা বাসনাজনিত কর্মশক্তির প্রভাবে জীব বা আত্মা পুগলের সংস্পর্শে এসে বদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং বদ্ধাবস্থায় আত্মার স্বরূপ প্রচ্ছন্ন থাকে। সুতরাং আত্মা পুদ্গল মুক্ত হলে আত্মার মুক্তি সম্ভব। বদ্ধাবস্থায় আত্মা যে দুঃখ-বেদনায় জর্জরিত থাকে, মুক্তাবস্থায় আত্মা কেবল সে দুঃখ ও বেদনার হাত থেকে
পরিত্রাণ লাভই করে না, অনাবিল আনন্দ ও শান্তিলাভ করে। জৈন মতে, আত্মার মুক্তির জন্য প্রথম কাজ হলো আত্মায় পুগলের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা এবং দ্বিতীয় কাজ হলো আত্মায় পূর্বসঞ্চিত পুগলের অপসারণ করা। প্রথম ক্রিয়ার নাম হলো সংবর এবং দ্বিতীয় ক্রিয়ার নাম হলো নির্জরা বা আত্মার কর্মনাশ। জৈনগণ বলেছেন, কামনা বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্যই আত্মার সাথে পুদ্গুলের সংযুক্তি ঘটে এবং এ কামনা বাসনার উৎপত্তি হয় অজ্ঞানতা হতে। সত্য বা যথার্থ জ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞানতা বা মিথ্যা জ্ঞানের নিবৃত্তি ঘটে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে সত্য বা যথার্থ জ্ঞানের দ্বারা আত্মায় পুগলের অনুপ্র
বেশ বন্ধ এবং পূর্বসঞ্চিত পুগলের অপসারণ সম্ভব। তাই জৈনগণ মুক্তি বা মোক্ষলাভের জন্য সম্যক জ্ঞান অর্থাৎ, তত্ত্বজ্ঞানের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। কিন্তু সম্যক জ্ঞানের জন্য প্রয়োজন ‘সম্যক দর্শন’। আবার সম্যক জ্ঞান ও সম্যক দর্শনের যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন সম্যক চরিত্রের। জৈন নীতিশাস্ত্র সম্যক জ্ঞান, সম্যক দর্শন ও সম্যক চরিত্রকে ত্রিরত্ন বলে অভিহিত করেছেন। নিম্নে ত্রিরত্ন
সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. সম্যক দর্শন : উমাস্বামীর মতে, সত্যের প্রতি শ্রদ্ধাই সম্যক দর্শন। জৈন মতে, শ্রদ্ধা অন্ধবিশ্বাস নয়। বিচার বিশ্লেষণজাত শ্রদ্ধাই সম্যক শ্রদ্ধা। জৈন লেখক মণিভদ্র বলেছেন, মহাবীরের প্রতি আমার কোন পক্ষপাতিত্ব নেই, আর কপিণের প্রতি আমার কোন বিদ্বেষ নেই। যার উপদেশ যুক্তিযুক্ত তাই আমি গ্রহণ করব। জৈনদের কথা হলো তীর্থঙ্করদের উপদেশ শ্রবণ বা পাঠ করার সময় কারো যেন বীতশ্রদ্ধ না থাকে, শ্রদ্ধা সহকারে তা শ্রবণ বা পাঠ করা উচিত। জৈনদের মতে, যারাই তীর্থঙ্করদের উপদেশাবলি পাঠ করুন না কেন, পাঠান্তে তীর্থঙ্করদের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধা বাড়বে ছাড়া কমবে না।
২. সম্যক জ্ঞান : জৈন মতে, আত্মা এবং অনাত্মা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা, ভ্রম ও সন্দেহমুক্ত বিস্তারিত জ্ঞানই সম্যক জ্ঞান। সম্যক জ্ঞান লাভের জন্য প্রয়োজন সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে দূরীভূত করা। কারণ এ প্রবৃত্তিগুলো সম্যক জ্ঞানের পরিপন্থী । জৈন মতে, কর্ম জাতীয় প্রতিবন্ধকতা অপসারিত হলে কেবল জ্ঞান বা সর্বজ্ঞতা লাভ করা যায়।
৩. সম্যক চরিত্র : জৈন মতে, সম্যক চরিত্রের মূলকথা হলো ক্ষতিকর কিছু না করা এবং যা কিছু কল্যাণকর তা করা। জৈনগণ বলেছেন, সম্যক চরিত্রের দ্বারা জীব বা আত্মায় কর্ম পুগলের অনুপ্রবেশের পথ রুদ্ধ এবং ক্তন কর্ম পুগলের ক্রমশ বিনাশ সাধিত হয়। চিন্তা সংযম, ইন্দ্রিয় সংযম, বাক্ সংযম, প্রবৃত্তি সংযম এবং রাগ সংযমকে জৈনরা সম্যক চরিত্রের অঙ্গ বলেছেন। আবার কোন কোন জৈন গ্রন্থকার পঞ্চ মহাব্রতকে সম্যক চরিত্রের অঙ্গ বলে নির্দেশ করেছেন। এ পঞ্চ মহাব্রত হলো অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, ব্রহ্মচর্য ও অপরিগ্রহ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, জৈন দর্শনের নীতিশাস্ত্র সম্পর্কিত উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি যে, জীব বা আত্মার যেমন বন্ধন আছে, তেমনি বন্ধন হতে জীব বা আত্মার মুক্তিও আছে। জৈনরা জীব বা আত্মার মুক্তির জন্য ‘সম্যক জ্ঞানের’ উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কিন্তু সম্যক জ্ঞান লাভের জন্য প্রয়োজন মুক্ত ও সর্বজ্ঞ তীর্থঙ্করদের উপদেশাবলি সযত্নে শিক্ষা করা। তাই জৈনরা বলেছেন, সম্যক জ্ঞানের জন্য প্রয়োজন সম্যক দর্শন। সম্যক দর্শন হলো সম্যক শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস, কিন্তু কেবল সম্যক জ্ঞান এবং সম্যক দর্শনের দ্বারা মুক্তি সম্ভব নয়, সম্যক জ্ঞান ও সম্যক দর্শনের সাথে প্রয়োজন সম্যক চরিত্রের। সুতরাং সম্যক জ্ঞান, সম্যক দর্শন ও সম্যক চরিত্র এ ত্রিরত্নেরই যুগ্মফল হলো মুক্তি বা মোক্ষলাভ