শ্ৰুত কী?

অথবা, জৈনরা শ্রুত বলতে কী বুঝিয়েছেন?
অথবা, যথার্থ জ্ঞানের প্রকার হিসেবে শ্ৰুত সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
জৈন দর্শন অতি প্রাচীন। এর আবির্ভাব হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগে। চব্বিশজন তীর্থঙ্কর জৈন দর্শনের প্রচারক। এই প্রচারকদের প্রথম জনের নাম ঋষভদেব এবং সর্বশেষ জনের নাম বর্ধমান। বর্ধমানের অপর নাম মহাবীর। এই মহাবীরকেই বস্তুত জৈন ধর্ম ও দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা বলে সকলে মনে করে। জনশ্রুতি আছে যে, জৈনধর্ম ও দর্শনের প্রধান গ্রন্থগুলোতে যেসব উপদেশ ও বাণী আছে সেসব মহাবীরেরই অবদান। শ্ৰুতি কী? জৈন মতে, পদার্থের যথাযথ ধারণাই জ্ঞান। অর্থাৎ যে জিনিস বাস্তবে যেরূপ তাকে সেই জিনিস বলে জানাকেই জ্ঞান বলা হয়। জৈন মতে, যথার্থ জ্ঞান পাঁচ প্রকার। এর মধ্যে শ্রুত অন্যতম। বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি বা শাস্ত্রবাক্যের উপর নির্ভর করে যে জ্ঞান লাভ করা হয় তাই শ্রুত, অর্থাৎ শব্দ প্রমাণ হতে যে জ্ঞান লাভ করা হয় তাকে জৈনগণ শ্ৰুত বলেন।
শ্রুত পরোক্ষ জ্ঞান : যে জ্ঞানকে সরাসরি বা সাক্ষাৎভাবে লাভ করা যায় না, সেই জ্ঞান পরোক্ষ জ্ঞান। শ্রুত জ্ঞানকে জৈনরা পরোক্ষ জ্ঞান বলেন। কারণ, এ জ্ঞানের ক্ষেত্রে জ্ঞাতার সাথে জ্ঞেয় বস্তুর কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটে না।
অপরের নিকট থেকে পাওয়া জ্ঞান : যারা দীর্ঘদিনের সৎ অভ্যাস এবং ভাল কাজের দ্বারা নিজেদেরকে সাধারণ মানুষ থেকে একটু উচ্চস্তরে নিয়ে গেছেন তারা বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে গণ্য। এই বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তিরা তাদের সাধনার দ্বারা যে জ্ঞান অর্জন করেছেন তা যখন অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেন তখন সে জ্ঞানকেই বলে শ্রুত। এক্ষেত্রে জ্ঞাতার কাছে
জ্ঞানটি হয় অন্যের নিকট থেকে পাওয়া।
বেদের জ্ঞান শ্রুত নয় : জৈনরা সাধারণত শাস্ত্র বাক্যের জ্ঞানকে শ্রুত বলেন। কিন্তু তারা বেদকে যথার্থ প্রমাণ হিসেবে স্বীকার করেন না। তাই বেদের বাক্যকে জৈনরা শ্রুত হিসেবে গ্রহণ করেন নি।
বিশুদ্ধ জ্ঞান নয় : শ্ৰুত কোন সাক্ষাৎ জ্ঞান নয়। এটি ইন্দ্রিয় বা ব্যক্তির অন্য কোন প্রত্যক্ষ উপায়ের উপর নির্ভরশীল জ্ঞান নয়। তাছাড়া বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে যাকে একজন গ্রহণ করে তাকে অন্যরা গ্রহণ নাও করতে পারে। আবার শাস্ত্র সাধারণত বিশেষ ধর্মের হয়। একধর্মের শাস্ত্রবাক্যকে অন্য ধর্মের লোকেরা মেনে নাও নিতে পারে। তাই জৈনরা
শ্রুতকে বিশুদ্ধ জ্ঞান হিসেবে মেনে নেননি।
সাক্ষাৎ জ্ঞান নয় : শ্ৰুত জ্ঞান পূর্ববর্তী কোন সময়ের অর্জিত জ্ঞান। যে ব্যক্তির কাছে থেকে এ জ্ঞান লাভ করা হচ্ছে এটি তার নিজস্ব অর্জিত জ্ঞান হতে পারে আবার তিনিও এগুলো শ্রুত হিসেবে লাভ করতে পারেন। সাধারণত ধর্মীয় জ্ঞানগুলো এ ধরনের হয়ে থাকে। যেহেতু জ্ঞান অর্জনের পর্যায় এবং পরবর্তীতে প্রদানকৃত জ্ঞান বা শ্রুতকালীন সময়ের মধ্যে কালিক পার্থক্য থাকে তাই এ জ্ঞান সাক্ষাৎ জ্ঞান নয়।
ভ্রান্তির সম্ভাবনা : জৈনদের মতে, শ্রুত জ্ঞানে ভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকে। যার কাছ থেকে এ জ্ঞান পাওয়া হয় তার জ্ঞানার্জনের সময় কোন ভ্রান্তি ঘটতে পারে আবার তিনি যখন জ্ঞানের শিক্ষাদেন তখন তা গ্রহনের সময় গ্রহণকারী ব্যক্তি ভুলভাবে তা গ্রহণ করতে পারে।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, জৈনরা যথার্থ জ্ঞান হিসেবে শ্রুতর যে বর্ণনা দিয়েছেন তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তারা শ্রুত বলতে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির বচন বা শাস্ত্রবাক্যকে নির্দেশ করেছেন। কিন্তু বেদবাক্যকে স্বীকার না করায় তাদের মতবাদ প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলা যায় যে, দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে জৈনদের
জ্ঞানতাত্ত্বিক এ মতবাদের গুরুত্ব যে অপরিসীম তা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।