জৈন দর্শনে জীব ও অজীব বলতে কী বুঝায়?

অথবা, জীব ও অজীব সম্পর্কে জৈনমত সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, জৈনরা জীব ও অজীবের স্বরূপের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ভারতীয় দর্শনে নাস্তিক সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে জৈন দর্শন অন্যতম। জৈন মতে পদার্থের যথাযথ ধারণাই জ্ঞান। কোন বস্তু বাস্তবে যে রকম তাকে সেভাবে জানাকেই জ্ঞান বলা হয়। যে ধারণায় কোন রকমের সন্দেহ থাকে সে ধারণাকে যথার্থ জ্ঞান বলা যায় না। যথার্থ জ্ঞান মানুষের উদ্দেশ্যসাধনে সহায়তা করে থাকে। যথার্থ জ্ঞানের অনুসন্ধান করতে গিয়ে জৈনরা জাগতিক উপাদানসমূহকে জীব ও অজীব এই দুই ভাগে ভাগ করেছেন।
জীব : জৈন মতে, চেতনাসম্পন্ন দ্রব্যই জীব। ভারতীয় দর্শনের অন্যান্য শাখায় যাকে আত্মা বলা হয়েছে জৈন দর্শনে তাকে জীব বলা হয়েছে। জৈন মতে, চেতনা বা চৈতন্য জীবের স্বভাবগত বা নিত্য ধর্ম। জৈনগণ বলেন, জীব কর্তা, জ্ঞাতা এবং সুখ-দুঃখের ভোক্তা। জীব বা আত্মা তার চেতনার দ্বারা অন্যদের যেমন আলোকিত করে, তেমনি নিজেকেও প্রকাশ
করে। জৈন মতে, জীব যেমন নিত্য বা অপরিণামী তেমনি বিভিন্ন পর্যায়ের কারণে পরিণামীও বটে। জীব বা আত্মা দেহ হতে ভিন্ন। এর নিজস্ব কোন আকার নেই। জীব যখন যে দেহে বাস করে তখন সেই দেহের আকার ধারণ করে।
অজীব : বিশ্ব জগতের একটি পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা প্রদানের জন্য জৈনরা অজীব নামে একপ্রকার সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করেন। অজীব বলতে তারা বুঝেছেন এমন সত্তাকে যার প্রাণও নাই, চৈতন্যও নাই। জৈনগণ পাঁচ প্রকার অজীবের কথা বলেছেন। সেগুলো নিম্নরূপ :
১. আকাশ : বিস্তৃত দ্রব্যকে ধারণ করাই আকাশের কাজ। জীব, পুদগল, ধর্ম ও অধর্ম এ সবকিছু আকাশেই অবস্থান করে। আকাশের অস্তিত্বকে প্রত্যক্ষের সাহায্যে জানা যায় না। অনুমানের সাহায্যে জানতে হয়। আকাশ ছাড়া কোন বিস্তৃত দ্রব্যের অস্তিত্ব সম্ভব নয়।
২. পুদগল বা জড় : জৈন মতে, যা পূর্ণাঙ্গ নয় এবং গলে যায় তাই পুদগল। পুদগলের চেতনা নাই এবং ইহা আকাশকে আশ্রয় করে থাকে । জৈনরা বলেন, পুদগলের চারটি ভ্রূণ আছে । যথা : রূপ বা বর্ণ, রস বা স্বাদ, গন্ধ এবং স্পর্শ।
৩. ধর্ম : সাধারণত ধর্ম বলতে পুণ্যকে বুঝায়। কিন্তু জৈনরা ধর্মকে সাধারণ অর্থে গ্রহণ করেন নি। যে দ্রব্যের জন্য বস্তুর গতি সম্ভব হয় সেই দ্রব্যকে জৈনরা বলেন ধর্ম। জৈন মতে, ধর্ম নিষ্ক্রিয় দ্রব্য এবং আকাশ ও কাল এর ন্যায় এটি প্রত্যক্ষগোচর নয়, তবে এটি অনুমানসিদ্ধ গতি এবং স্থিতির উপর নির্ভর করে এর অস্তিত্ব অনুমান করা হয়।
৪. অধর্ম : যে দ্রব্যের জন্য বস্তুর স্থিতি সম্ভব হয় তাকে জৈনরা অধর্ম বলেন। অধর্ম গতিশীল দ্রব্যের গতি রুদ্ধ করতে পারে না, তবে অধর্মের সাহায্যে গতিশীল দ্রব্য স্থিতি লাভ করতে পারে। অধর্ম নিত্য, নিরাকার এবং গতিহীন। এটি সমস্ত লোকালয়ে পরিব্যাপ্ত।
৫. কাল : কাল অনস্তিকায় অজীব দ্রব্য। এর কোন বিস্তৃতি বা কায় নেই। কাল একও অবি

ভাজ্য। একই কাল জগতের সর্বত্র বিরাজ করছে। জৈনরা পরমার্থিক ও ব্যবহারিক কালের কথা বলেছেন। অবিচ্ছিন্নতা পরমার্থিক কালের এবং সকল প্রকার পরিবর্তন ব্যবহারিক কালের লক্ষণ।
উপসংহার : পরিশেষে বলতে পারি যে, জীব ও অজীব সম্পর্কে জৈনরা যে মতবাদ প্রদান করেছেন তা দর্শনের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বের দাবিদার। তাদের এ মতবাদের বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা উপস্থাপিত হলেও তাদের মতবাদের দার্শনিক গুরুত্বকে অস্বীকার করার যে কোন উপায় নেই তা পরবর্তীকালের অধিকাংশ দার্শনিকই স্বীকার করেছেন।