জৈন মতে, জ্ঞানের প্রকারভেদ সংক্ষেপে আলোচনা কর।

অথবা, জ্ঞানের শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কিত জৈন মত সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
অথবা, জৈনরা জ্ঞানের কয়টি ভাগের কথা বলেছেন এবং সেগুলো কী কী?
উত্তর৷ ভূমিকা :
জৈন দর্শন হলো ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে অন্যতম নাস্তিক্যবাদী দার্শনিক সম্প্রদায় । জৈনরা প্রত্যক্ষ, অনুমান এবং শব্দ এ তিনটি প্রমাণ স্বীকার করেছেন। এ তিন রকমের প্রমাণের উপর নির্ভর করে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে তাদের ধারণা গঠন করেন এবং জ্ঞানতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তাদের মতে, জ্ঞাত বস্তুর সাথে জ্ঞাতার যখন সঠিক
পরিচয় ঘটে তখন জ্ঞানের উৎপত্তি হয়।
জ্ঞানের প্রকারভেদ : জৈনরা জ্ঞানকে প্রথমত দুই ভাগে ভাগ করেছেন। যথা : প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও পরোক্ষ জ্ঞান। পরোক্ষ জ্ঞানের আবার দুই ভাগ- মতি ও শ্রুত। প্রত্যক্ষ জ্ঞানেরও তিনটি ভাগ রয়েছে। যথা : অবধি, মনঃপর্যায় এবং
কেবল । সুতরাং জৈন মতে, জ্ঞান মোট পাঁচ প্রকার। নিম্নে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. মতি : পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মনের মাধ্যমে যে ‘জ্ঞান লাভ করা যায় তাকেই মতি বলে। `চক্ষু, কর্ণ প্রভৃতি বহিরিন্দ্রিয়ের সাহায্যে প্রাপ্ত বাহ্যবস্তুর প্রত্যক্ষ জ্ঞান, মনের সাহায্যে মানসিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে আন্তঃপ্রত্যক্ষ জ্ঞান, স্মৃতি, প্রত্যাভিজ্ঞা এবং অনুমান এসবই মতি জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত।
২. শ্ৰুত : বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি বা শাস্ত্রবাক্যের উপর নির্ভর করে যে জ্ঞান পাওয়া যায় তাই শ্ৰুত। অর্থাৎ শব্দ প্রমাণ হতে যে জ্ঞান লাভ করা হয় তাকে জৈনগণ শ্ৰুত বলেছেন। শ্রুত পরোক্ষ জ্ঞান, কেননা এটা অপরের নিকট হতে পাওয়া যায় । জৈনগণ বেদকে শব্দ প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করেন না।
৩. অবধি : জ্ঞাতা তার সাধনালব্ধ অসাধারণ শক্তি বলে সূদুর অতীত এবং ভবিষ্যৎ অতি দূরবর্তী এবং সূক্ষ্ম পদার্থ সম্পর্কে যে জ্ঞান অর্জন করে সে জ্ঞানই অবধি। অন্য জ্ঞান বা ইন্দ্রিয়ের উপর নির্ভর না করে জ্ঞাতা সাক্ষাৎভাবে এ জ্ঞান লাভ করে বলে জৈনগণ একে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলেছেন।
৪. মনঃপর্যায় : রাগ, হিংসা, দ্বেষ প্রভৃতি রিপুকে মানুষ জয় করতে পারলে তার ভেতর এমন একটি শক্তির উদ্ভব হয় যার দ্বারা তিনি অন্যের সুখ, দুঃখ প্রভৃতি মানসিক অবস্থাকে সাক্ষাৎভাবে জানতে পারে। অপরের মানসিক অবস্থাকে সাক্ষাৎভাবে জানতে পারে। অপরের মানসিক অবস্থাকে সাক্ষাৎভাবে জানাই হলো মনঃপর্যায়। মনঃপর্যায় প্রত্যক্ষ জ্ঞান, কেননা এটা ইন্দ্ৰিয়নির্ভর নয়। এ জ্ঞানে জ্ঞাতা সাক্ষাৎভাবে অন্যের মনের মধ্যে প্রবেশ করে থাকে।
৫. কেবল : সর্বকালের সর্বদেশের এবং সব ধরনের পদার্থের সাক্ষাৎ জ্ঞানকে কেবল জ্ঞান বলে জৈনরা অভিহিত করেছেন। কেবল জ্ঞান দেশ, কাল প্রভৃতি সব রকমের সীমা ও বিভেদের ঊর্ধ্বে। একমাত্র বন্ধনমুক্ত সিদ্ধ মানুষই এ রকম জ্ঞানের অধিকারী হতে পারে। কেবল জ্ঞান ইন্দ্রিয় বা অন্য কোন জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল নয় বলে একে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলা হয়। এ জ্ঞান বিশুদ্ধ। কারণ এখানে কোন মাধ্যম থাকে না।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, জৈনরা জ্ঞান বলতে সুস্পষ্ট ও যথার্থ ধারণাকে বুঝিয়েছেন। প্রকৃত জ্ঞান হতে হলে জ্ঞাতের সাথে জ্ঞেয়বস্তুর নির্দিষ্ট সম্পর্ক থাকতে হবে। তবে জৈনদের মতে, জ্ঞানের বস্তু জ্ঞান বা জ্ঞাতার উপর নির্ভরশীল নয়। জৈনগণ প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দকে প্রমাণরূপে স্বীকার করেছেন। জ্ঞানের ক্ষেত্রে পঞ্চইন্দ্রিয়, মন নাপ্তবাক্য, সাধনালব্ধ জ্ঞান ও সাক্ষাৎকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে জৈনরা স্বীকার করেছেন।