জৈন মতে, কৈবল্য বা মোক্ষলাভ সংক্ষেপে বর্ণনা কর।

অথবা, জৈনরা কৈবল্য বা মোক্ষলাভের যে উপায়ের কথা বলেছেন তা আলোচনা কর।
অথবা, কৈবল্য বা মোক্ষলাভ সম্পর্কিত জৈনদের মতবাদ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
দর্শনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, জৈন দর্শন একটি প্রাচীন দর্শন । জৈন দর্শনের আবির্ভাব হয় প্রাগৈতিহাসিক যুগে। জৈনদের মতে, কামনা-বাসনা জনিত কর্মশক্তির প্রভাবে জীব বা আত্মা পুদগলের সংস্পর্শে এসে বদ্ধাবস্থা প্রাপ্ত হয় এবং এই বদ্ধাবস্থায় আত্মারস্বরূপ প্রচ্ছন্ন থাকে। তাই আত্মা পুদগল হতে মুক্ত হলে আত্মার মুক্তি হয়। আত্মার মুক্তি হলে আত্মা স্বরূপে অবস্থান করে এবং তখনই জীবের কৈবল্য বা মোক্ষলাভের প্রশ্ন আসে।
মোক্ষলাভের ত্রিরত্ন : জৈন দার্শনিকরা সম্যক জ্ঞান, সম্যক দর্শন এবং সম্যক চরিত্রকে ত্রিরত্ন বলে অভিহিত করেছেন। তাদের মতে, কৈবল্য বা মোক্ষলাভ এই ত্রিরত্নেরই যুগ্মফল। তত্তার্থাধিগম সূত্র নামক জৈন দর্শনের একটি মূল গ্রন্থের প্রথম সূত্রেই বলা হয়েছে যে, সম্যক জ্ঞান, সম্যক দর্শন এবং সম্যক চরিত্রই মোক্ষলাভের পথ। এদের যে কোন একটির দ্বারা মোক্ষলাভ সম্ভব নয়। জৈনদের মতে, ত্রিরত্নের সমন্বয়ে যে প্রশস্ত পথ প্রস্তুত হয় তাই মুক্তিলাভের নির্ভুল পথ । নিম্নে ত্রিরত্নের বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
১. সম্যক জ্ঞান : জৈন মতে, আত্মা এবং অনাত্মা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা, ভ্রম ও সন্দেহমুক্ত বিস্তারিত জ্ঞানই সম্যক জ্ঞান। সম্যক জ্ঞান লাভের জন্য প্রয়োজন সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে দূরীভূত করা। কারণ এই প্রবৃত্তিগুলো সম্যক জ্ঞানের পরিপন্থি। জৈনমতে, কর্মজাতীয় প্রতিবন্ধক অপসারিত হলে কেবল জ্ঞান বা সর্বজ্ঞতা লাভ করা যায়।
২. সম্যক দর্শন : উমাস্বামীর মতে, সত্যের প্রতি শ্রদ্ধাই সম্যক দর্শন। কোন কোন লোকের শ্রদ্ধা সহজাত এবং স্বতঃস্ফুর্ত। আবার কোন কোন লোকের শ্রদ্ধা শিক্ষাজাত ও অনুশীলনসাপেক্ষ। জৈন মতে, শ্রদ্ধা অন্ধবিশ্বাস নয়। বিনা বিচারে তীর্থঙ্করদের উপদেশ মেনে নিতে হবে এ কথা জৈনরা বলেন না। তাদের মতে, বিচারবিশ্লেষণজাত শ্রদ্ধাই সম্যক শ্রদ্ধা। জৈনদের কথা হলো তীর্থঙ্করদের উপদেশ শ্রবণ বা পাঠ করার সময় কারো যেন বীতশ্রদ্ধা না থাকে। শ্রদ্ধা সহকারে তা শ্রবণ ও পাঠ করা উচিত। তবে উপদেশ গ্রহণ করা বা না করা পাঠকের বা শ্রোতার বিচারের উপর নির্ভর করে।
৩. সম্যক চারিত্র : জৈনমতে, সম্যক চারিত্রের মূলকথা হলো ক্ষতিকর কিছু না করা এবং যা কিছু কল্যাণকর তা করা। সম্যক চারিত্রের দ্বারা এমন আচরণ বুঝায় যার দ্বারা জীব কর্ম পুদগলের হাত হতে পরিত্রাণ লাভ করে। কারণ এই কর্ম পুদগলই জীবের বদ্ধাবস্থা তথা দুঃখ-দুর্দশার জন্য দায়ী। জৈনগণ বলেন, সম্যক চারিত্রের দ্বারা জীব বা আত্মায় কর্ম-
পুদগলের অনুপ্রবেশের পথ রুদ্ধ হয় এবং প্রাক্তন কর্ম পুদগলের ক্রমশ বিনাশ সাধিত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, সম্যক জ্ঞান, সম্যক দর্শন এবং সম্যক চারিত্রের মাধ্যমে মোক্ষলাভের যে বর্ণনা জৈন দার্শনিকরা দিয়েছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বের দাবিদার। ভারতীয় কোন কোন দার্শনিক সম্প্রদায় শুধুমাত্র সম্যক জ্ঞানকে মুক্তির উপায় বলে নির্দেশ করেছেন। কিন্তু জৈনরা তাদের সাথে একমত নয়। তারা বলেন, কেবলমাত্র ত্রিরত্নের সমন্বয়েই মোক্ষলাভের নির্ভুল পথ পাওয়া যায়।