অথবা, দুঃখবাদ কী? ভারতীয় দর্শন কি দুঃখবাদী?
অথবা, দুঃখবাদ বলতে কী বুঝ? ভারতীয় দর্শন দুঃখবাদী কি না আলোচনা কর।
উত্তর৷৷ ভূমিকা : দর্শন হচ্ছে জ্ঞানানুসন্ধানের দ্বারা জ্ঞান পিপাসার নিবৃত্তি এবং আগ্রহের ঐকান্তিকতা, বিষয়বস্তুর সামগ্রিকতা, উপলব্ধির মৌলিকতা, ব্যাখ্যার যৌক্তিকতা ও সুস্পষ্টতা দর্শনের প্রাণস্বরূপ। ভারতের প্রাচীন মনীষিগণ আত্মোপলব্ধির ঐকান্তিক মানসে জগৎ সম্বন্ধে যাবতীয় সম্ভাব্য প্রশ্নের সুচিন্তিত মতামত দ্বারা জীবনের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দার্শনিক বিশেষ করে পাশ্চাত্য দার্শনিকগণ নানাবিধ অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। তেমনি ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ হলো ভারতীয় দর্শন দুঃখবাদী দর্শন।
ভারতীয় দর্শন কি দুঃখবাদী : কিছু কিছু পাশ্চাত্য দার্শনিক ভারতীয় দর্শনকে দুঃখবাদী বলেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে দুঃখবাদী বলতে আমরা কি বুঝি? যে মতবাদ অনুসারে জগৎ ও জীবন দুঃখ ও নৈরাশ্যে পূর্ণ বা জগৎ ও জীবনে কোন সুখ ও আনন্দের আশা নেই সে
মতবাদকেই দুঃখবাদ বলে। প্রকৃত দুঃখবাদ অনুসারে দুঃখই জীবনের আদি, মধ্য ও অন্ত। ভারতীয় দর্শন দুঃখবাদী এবং ব্যবহারিক জীবনে অনিষ্টকর। এ অভিযোগ ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধে যারা উত্থাপিত করেছেন তারা বলেছেন ভারতীয় দার্শনিকরা তাদের দর্শনে জগৎ এবং জীবনের কেবল অন্ধকারময় রূপটি অঙ্কিত করেছেন। অভিযোগকারীরা বলেছেন, ভারতীয় দার্শনিকদের মতে মানুষ ব্যাধি, জ্বরা ও মৃত্যুর অধীন, জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ কেবল জ্বালা, যন্ত্রণা, দুঃখ, নৈরাশ্যের বেদনায় অস্থির। জগৎ ও জীবনে একবিন্দু সুখের আশা নেই। তাই অভিযোগকারীদের মতে, ভারতীয় দর্শন চরম দুঃখবাদী। যারা ভারতীয় দর্শনকে চরম দুঃখবাদী বলে ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন তারা যে সমগ্র ভারতীয়
দর্শন মনোনিবেশ সহকারে পাঠ করেন নি তা বলা অসমীচীন হবে না। জগৎ এবং জীবনে যে দুঃখ আছে এ কথা ভারতীয় দার্শনিকেরা অস্বীকার করেন নি। ভারতের প্রতিটি দার্শনিক সম্প্রদায়ই দুঃখের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। উপনিষদের মতে, সৎ চিৎ আনন্দস্বরূপ ব্রহ্ম ব্যতীত সবই দুঃখময়। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ জগৎকে দুঃখের আলয় বলেছেন। সাংখ্য দর্শনে কপিল বলেছেন, জগৎ এবং জীবন উভয়ই দুঃখে পরিপূর্ণ। তিনি আরো বলেছেন, জীব ত্রিতাপে তাপিত। অর্থাৎ তার মতে, তিন প্রকারের দুঃখ আছে। যথা : আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক এবং আধিদৈবিক। শারীরিক ও মানসিক দুঃখ আধ্যাত্মিক; মনুষ্যাদি, প্রাণী ও কীটপতঙ্গ হতে যে দুঃখের উদ্ভব হয় সে দুঃখ আধিভৌতিক। যেমন- জীব হত্যা, সর্পাঘাত ইত্যাদি। ভূত, প্রেত প্রভৃতি অলৌকিক কারণজাত যে দুঃখ তা আধিদৈবিক। যোগদর্শনে পতঞ্জলি জগৎকে দুঃখময় বলেছেন। যোগ দার্শনিকদের মতে, দুঃখ তিন প্রকারের। যথা : পরিণাম দুঃখ, তাপ দুঃখ ও সংস্কার দুঃখ। সুখপ্রদ বস্তু বা বিষয়ের পরিবর্তনের ফলে বিয়োগজনিত দুঃখের সৃষ্টি হয়। তাই কোন বস্তু আপাতত সুখ প্রদান করলেও পরিণামে তা দুঃখ প্রদান করবে। তদুপরি সুখভোগের দ্বারা সুখভোগের তৃষ্ণা বৃদ্ধি পায়; ফলে পরিণাম দুঃখপ্রদ হয়। দ্বেষজাত দুঃখই অপদুঃখ। সংস্কার হতে যে দুঃখের সৃষ্টি হয় তাই সংস্কার দুঃখ। যোগ দার্শনিকগণ বাসনাকে সংস্কার অর্থে গ্রহণ করেছেন। চার্বাক ব্যতীত ন্যায়, সাংখ্য, মীমাংসা প্রভৃতি যেসব দর্শন জগতে জীবের বদ্ধাবস্থা স্বীকার করেছেন তারা জগতে দুঃখের অস্তিত্বকে স্বীকার করেছেন। কারণ জীবের বদ্ধাবস্থায় কখনো অনাবিল সুখশান্তি সম্ভব নয়। বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখবাদের একটি সুস্পষ্ট রূপ দেখা যায়। বৌদ্ধ দর্শনের মতে, সবই দুঃখময়। যেমন- জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মরণ দুঃখ, প্রিয় বিয়োগ দুঃখ, অপ্রিয়সংযোগ দুঃখ, কাম্যবস্তু লাভে বঞ্চনা দুঃখ, এমনকি
যাকে আমরা সুখ বলি তার মধ্যেও দুঃখের বীজ প্রচ্ছন্ন আছে।
“ছাড়া গৌতম বুদ্ধের মতে, সবই অনিত্য এবং যা অনিত্য তাই দুঃখময়। দুঃখানুভূতি হতেই ভারতের প্রতিটি দর্শন উদ্ভূত । যদিও ভারতীয় প্রতিটি দার্শনিক সম্প্রদায় দুঃখের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন, যদিও ভারতের প্রতিটি দর্শন দুঃখের অনুভূতি হতে উদ্ভূত, তথাপি ভারতীয় দর্শনকে নিছক দুঃখবাদী বলা চলে না। কারণ দুঃখ যে জীবনের চরম পরিণতি এ কথা কোন ভারতীয় দর্শন স্বীকার করে নাই। ভারতীয় দর্শনের আদিতে দুঃখের কথা থাকলেও এটা ভারতীয় দর্শনের শেষ কথা নয় । আশা ও আনন্দই ভারতীয় দর্শনের শেষ কথা ও পরিণতিস্বরূপ। ভারতীয় দার্শনিকরা বলেছেন, দুঃখানুভূতি আছে বলেই দুঃখ হতে পরিত্রাণের জন্য দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞান প্রভৃতির সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের প্রতিটি দর্শন বার বার এ কথা ঘোষণা করেছেন যে, দুঃখের অবসান ঘটিয়ে দুঃখ হতে মুক্তিলাভ সম্ভব। উপনিষদে বলা হয়েছে, মানুষ অমৃতের সন্তান। সুতরাং অমৃতেই তারা বিলীন হয়ে যাবে। গীতায় বলা হয়েছে, কর্মফলের আশা ত্যাগ করে নির্মোহচিত্তে যে ব্যক্তি কর্ম করে তিনিই মুক্তি পেতে পারেন। সাংখ্য দর্শনের মতে, দুঃখ আছে বলেই মানুষ দুঃখ নিবৃত্তির উপায় অনুসন্ধান করে। সাংখ্য দর্শনে দুঃখ নিবৃত্তির অবস্থাকেই জীবনের পুরুষার্থ বা শ্রেষ্ঠ কাম্যবস্তু বলে অভিহিত করা হয়েছে। যোগদর্শনে সমাধিকে জাগতিক দুঃখ হতে মুক্তিলাভের শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ন্যায় ও বৈশেষিক দর্শন স্বীকার করে যে, মিথ্যা জ্ঞানই দুঃখের মূল কারণ। সত্য জ্ঞানের দ্বারা মিথ্যা জ্ঞান দূরীভূত হলে মানুষ মোক্ষলাভ করে এবং মোক্ষলাভ করলে সব দুঃখের নিবৃত্তি ঘটে। মীমাংসা দর্শনে সকাম কর্মকে জীবের দুঃখের কারণ এবং আত্মজ্ঞান ও বৈরাগ্যকে মুক্তিলাভের একমাত্র উপায় বলেছেন। মীমাংসকগণের মতে, মুক্ত আত্মার কোন দুঃখ থাকে না। বেদান্ত দর্শনে অবিদ্যাকে দুঃখের মূল কারণ বলা হয়েছে এবং ব্রহ্মজ্ঞান লাভে অবিদ্যা দূরীভূত হলে মানুষ ভূমানন্দের অধিকারী হয় বলে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে।
যে বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখবাদের চরম রূপ অঙ্কিত হয়েছে সে বৌদ্ধদর্শনই আবার আশার বাণী শুনিয়েছে। কঠোর সাধনায় গৌতম বুদ্ধ চারটি সত্যের সন্ধান পেয়েছেন। যথা :
ক. দুঃখ আছে, খ. দুঃখের কারণ আছে, গ. দুঃখের নিবৃত্তি আছে এবং ঘ. এ দুঃখ নিবৃত্তির উপায়ও আছে। বৌদ্ধ দর্শনের মতে, মানুষ নিজের চেষ্টায় দুঃখ হতে নিবৃত্তি পেতে পারে। বুদ্ধদেব বলেছেন, মানুষ নির্বাণ লাভ করলে
পরম সুখের অধিকারী হয়। বৌদ্ধ দর্শনের এ আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে ভারতের বিভিন্ন দর্শনবাদের সারাংশ বলা যেতে পারে । ভারতীয় দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি যদি এ রকম হয় তবে ভারতীয় দর্শনের বিরুদ্ধে দুঃখবাদের অভিযোগ একান্তই অসার। “অশেষ দুঃখের সম্পূর্ণ নিবৃত্তি যে দর্শনের আদর্শ, সে দর্শন নৈরাশ্যবাদী হতে পারে না।” ম্যাক্স মুলার বলেছেন, “যেখানে সকল ভারতীয় দর্শন দুঃখকে দূরীভূত করতে সক্ষম বলে ঘোষণা করে। সেখানে প্রকৃত দুঃখবাদ বলতে আমরা যা বুঝি সে অর্থে ভারতীয় দর্শনকে দুঃখবাদী বলা যায় না।”
উপসংহার : পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ভারতীয় দর্শন আশাবাদী, দুঃখবাদী নয়। ভারতীয় দর্শনের আদিতে দুঃখ থাকলেও পরিণামে মুক্তি বা মোক্ষ আছে। যার শেষ বা পরিণাম ভালো তাই প্রকৃত বা স্থায়ী দর্শন। সুতরাং ভারতীয় দর্শন আশা ও মুক্তিবাদের দর্শন। ভারতীয় দর্শন ছাড়া পৃথিবীর কোন দর্শন এ জগতের দুঃখপীড়িত মানুষকে এরূপ আশা ও মুক্তির বাণী শুনিয়েছে কিনা সন্দেহ। ম্যাক্স মুলার বলেছেন, “যেখানে সব ভারতীয় দর্শনের লক্ষ্য অজ্ঞতা প্রসূত দুঃখের নিবৃত্তি
এবং সত্যজ্ঞান হতে উদ্ভূত চরম শান্তিলাভ, সেখানে আমাদের তাকে দুঃখবাদ না বলে সুখবাদী বলা উচিত।”