লোকায়ত দর্শনের বৈশিষ্ট্য লিখ।

অথবা, লোকায়ত দর্শনের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখ কর।
অথবা, ভারতীয় দর্শনের লোকায়ত ধারার বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে আলোচনা কর।
অথবা, চার্বাক দর্শনের লোকায়ত দিকের বৈশিষ্ট্য তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ভারতীয় দর্শন বলতে আমরা কেবল অধ্যাত্মবাদী জীবন ভাবনাকে বুঝি না। ভারতীয় দর্শনে জড়বাদী দর্শন বলতে আমরা চার্বাক দর্শনকে বুঝি? জড়বাদ বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, যে মতবাদ অনুযায়ী জড়েরই একমাত্র সত্তা আছে বলে উল্লেখ আছে বলে ধরা হয় এবং বলা হয়, এ জগতের সবকিছু জড় থেকে উদ্ভূত। সাধারণ মানুষের চিন্তা ও ভাবধারা চার্বাক মতবাদের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে বলে এ দর্শনকে লোকায়ত দর্শন নামে অভিহিত করা হয়।
লোকায়ত দর্শনের বৈশিষ্ট্য : ‘লোক’ শব্দের দুটি অর্থ আছে, যথা : (১) সাধারণ মানুষ, (২) ইহজগৎ। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের চিন্তা এবং ইহজগৎ সম্পর্কিত চিন্তাই লোকায়ত দৰ্শন। লোকায়ত দর্শনের বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ :
১. ইন্দ্রিয় সুখবাদী দর্শন : লোকায়ত দৰ্শন বলতে সাধারণ মানুষের ইন্দ্রিয় সুখবাদী দর্শনকে বুঝায়। সাধারণ মানুষ দর্শনের জটিল তত্ত্বকথা বোঝে না বা তারা এগুলো নিয়ে মাথাও ঘামায় না। দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ বিষয়াবলি নিয়েই তাদের চিন্তা অর্থাৎ ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তিই তাদের কাছে মুখ্য। তাই তাদের চিন্তা ইন্দ্রিয় সুখকেন্দ্রিক।
২. ইহলোকই দর্শনের চারণভূমি : চার্বাক দর্শনকে লোকায়ত দর্শন বললে এক অর্থে বুঝতে হবে এটা সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচলিত দর্শন। আর সাধারণ মানুষের মতে ইহলোকই এ দর্শনের চারণভূমি।
৩. ইহজগৎ ভিত্তিক দর্শন : পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেন, লোকায়ত দর্শন বলতে সাধারণ মানুষের ইহজগৎভিত্তিক দর্শন বোঝায়। সাধারণ মানুষের যাবতীয় চিন্তা ইহজগতের বিষয়াবলিতেই কেন্দ্রীভূত।
৪. বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে তত্ত্বের সত্যতা অস্বীকার : পঞ্চালন তর্করত্ন বলেন, লোকায়ত দৰ্শন স্থুল বস্তুজগৎ ব্যতীত তার বাইরে বা ঊর্ধ্বে অন্য কোন তত্ত্বকে সত্য বলে উল্লেখ করে না, মেনেও নেয় না।
৫. পদার্থসমূহের দর্শন : বৌদ্ধ ভাষ্যকার বুদ্ধঘোষ লোকায়ত শব্দের ব্যুৎপত্তিগত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, লোক অর্থ ইহলোক আর আয়ত অর্থ আয়তন যা পদার্থের ভিত্তি। পদার্থের এ ধারণা থেকে এ দর্শনকে মনিভদ্র পদার্থ-সার্থ অর্থাৎ জাগতিক পদার্থসমূহের দর্শন বলে উল্লেখ করেছেন। তবে এ পদার্থ অবশ্যই জড় পদার্থ, আধ্যাত্মিক পদার্থ নয়।
৬. মুক্কত চিন্তার অধিকারী দর্শন : দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লোকায়ত বলতে ঋজু এবং মুক্তচিন্তার অধিকারী দর্শনকে বোঝান। তিনি মনে করেন সাধারণ মানুষের চিন্তা কোন জটিল তাত্ত্বিক চিন্তা নয় বা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তা পরিচালিত নয়। দৈনন্দিন জীবনের বিষয় লোকায়ত দর্শনের উদ্ভব।
৭. সুখসংগত বস্তুদর্শন : লোকায়ত দর্শনে কোন মতবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা থাকে না এবং অন্যদের মতের অসারতা নিয়েও ভাবা হয় না। বস্তুজগতের বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের কাছে যেভাবে উপস্থাপিত হয় তা সুসংহতভাবে বাস্তব জীবনে কাজে লাগানোর প্রত্যয়ই লোকায়ত দর্শনের মূলকথা।
৮. জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি : চার্বাক দর্শনের লোকায়ত ধারা চরম জড়বাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। তাদের মতে, এ জগতে একমাত্র জড়পদার্থেরই মৌলিক সত্তা আছে। আর জগতের সবকিছুর উদ্ভব হয়েছে জড় পদার্থ থেকেই। তারা মনে করেন, এমনকি প্রাণ এবং মনেরও উদ্ভব হয়েছে জড় পদার্থ থেকে।
উপসংহার : উপরোল্লিখিত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায় যে, লোকায়ত দর্শন হলো সাধারণ মানুষের ইহজগৎকেন্দ্রিক দর্শন যা ভারতীয় দর্শনে প্রচলিত ছিল। এ দর্শন ছিল ইন্দ্রিয় সুখবাদী এক প্রকার সরল জড় দর্শন।
ভারতীয় দর্শনে মীমাংসা সম্প্রদায়ের দর্শন ছিল লোকায়ত দর্শনের খুব কাছাকাছি। চার্বাক দর্শন ও মীমাংসা দর্শনে প্রাচীন বৈদিক ঐতিহ্যের আদিম জীবনমুখিনতার প্রতি সমান প্রবণতা দেখা যায়।