অথবা, সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কিত দ্বান্দ্বিক মতবাদ সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : সামাজিক পরিবর্তন চিরন্তন ও শাশ্বত। মানুষ সমাজের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। আর এ পরিবর্তন আছে বলে যাযাবর ও গুহাবাসী মানুষ আজ সভ্য ও সুন্দর সমাজে গগণচুম্বী অট্টালিকা তৈরি করে বসবাস করছে। মানুষের প্রয়োজনে সামাজিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়। সামাজিক পরিবর্তন সর্বদা একই নিয়মে হয় না। আবার এ পরিবর্তনের ফলাফল বিভিন্ন সমাজভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে।
সামাজিক পরিবর্তনের দ্বান্দ্বিক মতবাদ (Conflict theory in social change) : সামাজিক পরিবর্তন বিরামহীনভাবে চলতে থাকে। সামাজিক পরিবর্তন আলোচনায় যেসব মতবাদ বা তত্ত্ব রয়েছে, দ্বান্দ্বিক মতবাদ তার মধ্যে অন্যতম। বস্তুত দ্বন্দ্বমূলক তত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো সমাজ দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত হয়। সাম্প্রতিককালে এ তত্ত্বটি খুব
গুরুত্ব পেয়েছে। এ তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা হলেন মার্কস ও হেগেল । Marx ও Hegel সমাজ পরিবর্তনের দুটি মুখ্য উপাদানের কথা বলেছেন । যথা :
ক? ক. প্রযুক্তি বা উৎপাদন শক্তির উন্নতি ও খ. সামাজিক শ্রেণীসমূহের মধ্যে সম্পর্ক।
Hegel বলেছেন, একটি idea, dynamic process এর মাধ্যমে এগিয়ে যায়। তিনি একে Dialectic বলেছেন । Dialectic তিনটি Stage এ পরিচালিত হয় । যথা :
মার্কস বলেন যে, উৎপাদন ব্যবস্থা সমাজের শ্রেণীবিন্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করে। শ্রেণীসংগ্রামের প্রক্রিয়ার মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমে বিলুপ্ত হয়ে সমাজ পুঁজিবাদী শাসক শ্রেণী ও শোষিত শ্রমিক শ্রেণীতে বিভক্ত হবে। এদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্বের ফলে সমাজে আসবে পরিবর্তন। তিনি আরো বলেন যে, বুর্জোয়া শিল্পপতি নিজেরাও মুনাফার লক্ষ্যে উৎপাদন যন্ত্রের উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় রত হয় এবং কালক্রমে তা তাদেরই পরাজয় ডেকে আনে। মার্কস তাই বিশ্বাস করেন যে, মানবীয় ইতিহাস সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে সঠিক বলে প্রমাণিত হবে। আবার অমার্কসীয় চিন্তাবিদ যদি বলেন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় মানবীয় প্রচেষ্টাই সমাজ পরিবর্তনের মূলে তাহলে মার্কস হয়তো জীবিত থাকলে সমত্তিই জানাতনে। যদি বলা হতো পরস্পর বিরোধী মতামতের ঘাতপ্রতিঘাতে নতুন ধ্যানধারণার সূচনা হয়, তাহলে মার্কস হয়তো দৃঢ়ভাবে তার সমর্থন করতেন। তিনি আরো বলতেন, একেই বলে দ্বন্দ্ববাদ। কিন্তু এ দ্বন্দ্ব শুধু আদর্শের দ্বন্দ্ব নয়, এ দ্বন্দ্ব সামাজিক শ্রেণীসমূহের স্বার্থের দ্বন্দ্ব।
Marx ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে সামাজিক পরিবর্তনকে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোকে পরিবর্তনশীলতার ব্যাখ্যায় ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন, সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন হলেই সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সম্ভব। তিনি প্রাচীনকাল থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত সমাজব্যবস্থাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, সমাজ বিকাশের প্রতিটি স্তরে এক একটি উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল এবং সামাজিক শ্রেণীগুলো ছিল পরস্পর দ্বন্দ্বের মধ্যে। বস্তুত উৎপাদনের বস্তুগত শক্তির মধ্যে পরিবর্তন আসলে এক সময় প্রচলিত উৎপাদন সম্পর্কের সাথে এক সংঘাতের সম্মুখীন হয়। এ অবস্থায় সমাজে বিপ্লব দেখা যায়। প্রতিটি বিপ্লব সামাজিক পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কিত যেসব মতবাদের উদ্ভব ঘটেছে সেগুলোর মধ্যে দ্বান্দ্বিক মতবাদ অন্যতম। এ তত্ত্বে দেখানো হয়েছে সমাজে দুটি শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্বের মাধ্যমে সে সমাজের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং সেখানে নতুন সমাজের উদ্ভব ঘটে। এভাবে পরস্পর বিরোধী শ্রেণীর দ্বন্দ্ব সামাজিক পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে।