অথবা, সামাজিক পরিবর্তনের কারণসমূহের বিবরণ দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা : সমাজ রাষ্ট্রের চেয়ে বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্রের জন্য নির্দিষ্ট ভূখণ্ড আবশ্যক, সমাজের জন্য নয়। কয়েকটি রাষ্ট্রের আয়তনের মধ্যে সমাজ বিদ্যমান, আবার একই রাষ্ট্রের মধ্যে বহু সমাজের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। অধ্যাপক ম্যাকাইভার এর মতে, “এটা সমগ্র সামাজিক সম্পর্কের ব্যবস্থা” (The whole system of social relationship)। তিনি আরো বলেছেন, যেসব সামাজিক সম্মতির মধ্যে আমরা জীবনযাপন করি তার সঠিক রূপই হলো সমাজ।” আর এ সমাজে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে। তখন এর নাম হচ্ছে সামাজিক পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের অর্থ হচ্ছে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জীবনাদর্শের পরিবর্তন ।
সামাজিক পরিবর্তনের কারণ (Cause of social change) : দিন দিন সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। কারণ পরিবর্তনই সমাজের প্রধান ধর্ম। প্রাচীন যুগের সমাজের সাথে যেমন মধ্যযুগের সমাজের ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তেমনি মধ্যযুগের সমাজের সাথেও আধুনিক যুগের সমাজের ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। তার কারণ সমাজ পরিবর্তনশীল। নিম্নে সামাজিক পরিবর্তনের কারণগুলো তুলে ধরা হলো :
১. ঔপনিবেশিক কারণ : ঔপনিবেশিকতাবাদকে সামাজিক পরিবর্তনের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। কারণ কোন উন্নত জাতি সনাতন সমাজে প্রবেশের সাথে সাথে সেখানকার সমাজে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, পর্তুগিজ এবং ব্রিটিশদের কথা উল্লেখ করা যায়। তারা যখন ভারতবর্ষে আগমন করে, তখন এদেশের সমাজব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে থাকে।
২. অনুকরণ প্রক্রিয়া : মানুষ স্বভাবতই অনুকরণপ্রিয়। আর তৃতীয় বিশ্বের ক্ষেত্রে কোন কথাই চলে না। যেমন- পাশ্চাত্য দেশের দিকে নজর দিয়ে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা তাদের পোশাক পরিচ্ছদ ও ধ্যানধারণায় পরিবর্তন এনেছে। তারা এখন বাবাকে ‘ড্যাড’ এবং মাকে ‘মাম্মি’ বলতে পছন্দ করে।
৩. শিল্পায়ন : শিল্পায়ন সামাজিক পরিবর্তনের একটি অন্যতম বাহন। এর ফলে সমাজে নতুন নতুন ভাবধারা জন্ম নেয় । এ ভাবধারাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থা। এখানকার মানুষ হয়ে উঠে পুরোপুরি সামাজিক।
৪. শ্রেণীবৈষম্য দূরীকরণ : সামাজিক পরিবর্তন মানুষের মনোবল বাড়িয়ে দেয়। আর এর ফলে সমাজের পরিচালকরা ধনী, দরিদ্র, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার সুযোগ পায়। সেজন্য তারা বিভিন্ন আর্থসামাজিক কর্মসূচি গ্রহণ করে ধনীদরিদ্র, উঁচুনিচু সবার মধ্যে ব্যবধান কমানোর চেষ্টা করেন। তাই বলা যায়, শ্রেণীবৈষম্য সামাজিক পরিবর্তনের বাহন হিসেবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
৫. উন্নত কৃষি ব্যবস্থা : উন্নত কৃষি ব্যবস্থা সামাজিক পরিবর্তনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে বলে অনেকের বিশ্বাস। কৃষি ব্যবস্থা যদি, অনুন্নত হয় তবে উৎপাদন হবে অতি সামান্য। আর এতে জনমনে আসবে অশান্তি। তাই কৃষি ব্যবস্থা উন্নত হলে উৎপাদন বেশি হবে। উৎপাদন বেশি হলে জনমনে আসবে শান্তি। এর ফলে তারা সমাজে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক
কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটিয়ে সামাজিক পরিবর্তনে অবদান রাখতে পারবে।
৬. সুষম বণ্টন ব্যবস্থা : বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায়, সেখানে অসম বণ্টন ব্যবস্থা বিদ্যমান। এটা হয়ে থাকে অনেকটা শাসকের স্বজনপ্রীতি এবং নির্বুদ্ধিতার কারণে। এখানে অধিকাংশ দেশের অর্থ মূলত মুষ্টিমেয় লোকের হাতে ন্যস্ত থাকে। ফলে সমাজের একটা বিরাট অংশ অর্থনৈতিক
সুফল থেকে বঞ্চিত হয় ৷ আর এ অবস্থা সামাজিক পরিবর্তনে বাধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর সম্পদের সুষম বণ্টন হলে সামাজিক পরিবর্তনে বাধা না এসে আসে সাফল্য। তাই বলা যায়, সুষম বণ্টন ব্যবস্থা সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম চাবিকাঠি ।৭. সঠিক উন্নয়ন পরিকল্পনা : একটি দেশের সম্পদের পরিমাণ যত বেশিই থাকুক না কেন, তার সঠিক ব্যবহার না হলে কখনই সামাজিক পরিবর্তন আসবে না। এজন্য প্রয়োজন সঠিক উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা। তাহলে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার হবে। ফলে সমাজে আসবে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন।
৮. সঠিক বিনিয়োগ : সঠিক বিনিয়োগ সামাজিক পরিবর্তনের একটি অন্যতম মাধ্যম। বিনিয়োগ করার পূর্বে নির্ধারণ করতে হবে কোন খাত লাভবান। বার বার লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। তাহলে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন আসবে। আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলেই সমাজ সমৃদ্ধ হবে। আর তা হবে সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে।
৯. গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ : গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সামাজিক পরিবর্তনের একটি অন্যতম মাধ্যম। এর মাধ্যমে জনগণ সনাতন সমাজব্যবস্থার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আধুনিকতার পথ ধরতে সক্ষম হয়। বর্তমান বিশ্বের সমাজব্যবস্থার দিকে তাকালে রাজতান্ত্রিক, অভিজাততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ধারার চেয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারা অনেকটা ভিন্ন প্রকৃতির বলে মনে হয় । এখানে জনগণের জন্য রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের জন্য জনগণ নয়।
১০. পরিবর্তনের বাহন হিসেবে ধর্ম : ধর্ম সামাজিক জীবনে আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম। ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে জনসমষ্টি বা জাতির আচার আচরণ ও জীবনে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন ঘটে থাকে। যেমন- আরবের ইসলামপূর্ব পৌত্তলিক সমাজ ও ইসলামোত্তর মুসলিম সমাজ ধর্মীয় পরিবর্তনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
১১. পরিবর্তনের মাধ্যম হিসেবে রাজনীতি : যে কোন দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে সে দেশের সামাজিক পরিবর্তন ঘটে। যেমন- পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার সামাজিক অবস্থা ও স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থার মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান বিদ্যমান। আবার কমিউনিস্ট শাসিত সমাজের সামাজিক অবস্থা ও গণতান্ত্রিক বা
সামরিক সমাজব্যবস্থার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান বিদ্যমান। তাই বলা যায়, রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে সামাজিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়।
১২. বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ভূমিকা : যে কোন দেশের সামাজিক পরিবর্তনে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর অবদান কম নয়। তারা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সমাজের উন্নয়ন তথা সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন পথ বাতলে দেয়।
১৩. সেনাবাহিনীর প্রভাব : সামাজিক পরিবর্তনে সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। তারা সমাজের যে কোন স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক অবস্থায় আত্মনিয়োগ করে। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমাজ থেকে সকল ধরনের সন্ত্রাস নির্মূল করতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করা যায় ৷
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সামাজিক পরিবর্তন হচ্ছে আর্থসামাজিক সম্পর্কের বা. সমাজকাঠামোর পরিবর্তন। বস্তুত উল্লেখিত কারণগুলো ছাড়াও সামাজিক পরিবর্তনের বাহন হিসেবে আমরা আরো কিছু রুচিবোধের পরিবর্তন, জনসংখ্যা হ্রাসবৃদ্ধি, জন্মমৃত্যুর হার নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি। আর এসবের প্রভাবে উত্তরোত্তর সামাজিক
কারণ উল্লেখ করতে পারি। যেমন- জাতীয়তাবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য