অথবা, বাংলাদেশের সমাজে পতিতাবৃত্তির কুফল বর্ণনা কর।
উত্তর ভূমিকা : বাংলাদেশ একটি সামাজিক সমস্যাগ্রস্ত দেশ। এদেশের অনেকগুলো সামাজিক সমস্যার মধ্যে অন্যতম সামাজিক সমস্যা হচ্ছে পতিতাবৃত্তি। পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য, বর্বর, ঘৃণ্য ও আদিম বৃত্তি হচ্ছে পতিতাবৃত্তি। এটি নগরসভ্যতার জন্য অভিশাপ। সকল প্রকার ধর্মীয়, সামাজিক নিয়মনীতি এবং আদেশকে উপেক্ষা করে সূদুর প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান সভ্যজগতেও এ প্রথাটি টিকে আছে এবং ভবিষ্যতেও সমাজজীবন থেকে এ ঘৃণিত পেশা বিদূরিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বরং সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে পতিতাবৃত্তি আরও সৌখিন এবং মার্জিত রূপ পরিগ্রহ করছে।
নেতিবাচক প্রভাব : নিম্নে পতিতাবৃত্তির নেতিবাচক প্রভাবগুলো আলোচনা করা হলো :
১. জনস্বাস্থ্যের অবনতি : পতিতাবৃত্তি বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্যের অবনতিতে ভূমিকা রাখে। শামীম আল আমিন বলেছেন, “সরকারের চতুর্থ সেরোলজিক্যাল সার্ভিলেন্স প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, যৌনকর্মীদের যৌন সঙ্গীর সংখ্যা এশিয়ার অন্য যে কোন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে অধিক হলেও যৌনকর্মে কনডম ব্যবহারের হার এখানে জরিপ অনুযায়ী, এদেশে পতিতালয়, হোটেলের যৌনকর্মীরা এবং ভাসমান যৌনকর্মীদের খদ্দেরদের শতকরা ৯৬ ভাগ কনডম ব্যবহার করে না।” পতিতারা খদ্দেরদের কনডম ব্যবহারে বাধ্য করতে পারেনা। এভাবে পতিতারা অনিরাপদ যৌন সংসর্গের মাধ্যমে সমাজে এইডস, গনোরিয়া, সিফিলিসের ন্যায় ঘাতক ও জটিল রোগ সমাজে বিস্তার করছে। বাংলাদেশে এইডস বিস্তারের জন্য পতিতারা বহুলাংশে দায়ী থাকে সর্বনিম্ন।
২. আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি : পতিতাবৃত্তির সাথে জড়িত অনেক নারীই আত্মহত্যা করে। কোন নারী যদি একবার পতিতাবৃত্তির সাথে জড়িয়ে পড়ে তখন তার পক্ষে স্বাভাবিক সামাজিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব হয় না। নারী সমাজে নিজেকে অসহায় সত্তা হিসেবে চিহ্নিত করে। শিক্ষিত তরুণীদের পতিতাবৃত্তি গ্রহণের পর অনেককে আত্মহত্যা করতে দেখা যায় ।
৩. বিমর্ষতা : পতিতাবৃত্তির প্রভাব সমাজের সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়। পতিতাদের সামাজিক জীবনে বিমর্ষ থাকতে দেখা যায়। তাছাড়া তাদের মধ্যে অপরাধবোধ জাগ্রত হলে নিজেকে দোষী প্রমাণিত করে। এ থেকে বিমর্ষতার সৃষ্টি হয়। একই সাথে যারা পতিতালয়ে গমন করে তারাও অপরাধবোধের কারণে বিমর্ষ থাকে।
৪. অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি : পতিতাবৃত্তির কারণে বাংলাদেশের সমাজে আর্থিক সংকটের সৃষ্টি হয়। যারা পতিতালয়ে গমন করে তাদেরকে মোটা অঙ্কের টাকা গুণতে হয়। এভাবে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক আর্থিক সংকটের সৃষ্টি হয়।
৫. মৃত্যুহার বৃদ্ধি : পতিতারা বিভিন্ন জটিল যৌনরোগের ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে। এইডসের ন্যায় ঘাতক ব্যাধি পতিতাদের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি বিস্তার ঘটে। যৌনরোগে আক্রান্তরা মৃত্যুবরণ করে এবং মৃত্যুহার এভাবে বৃদ্ধি পায়।
৬. সামাজিক অধঃপতন : পতিতাবৃত্তি নৈতিকতা বিরোধী কাজ। পতিতাবৃত্তি সমাজকে ক্রমশ অধঃপতনের দিকে ধাবিত করে । যুবশ্রেণী পতিতাবৃত্তির কবলে পড়ে অধঃপতিত হচ্ছে।
৭. চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি : পতিতাবৃত্তি বিভিন্ন রোগের আকর হিসেবে কাজ করে। যৌনবাহিত বিভিন্ন রোগ অনিরাপদ যৌন মিলনের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে। সমাজে যৌনরোগের বিস্তার ঘটলে মানুষের চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। এভাবে সমাজে দরিদ্রতা দেখা দেয়।
৮. প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস : পতিতাবৃত্তির মাধ্যমে সমাজে বিভিন্ন রোগ বিস্তার লাভ করে। এগুলোর মধ্যে যৌনবাহিত রোগই প্রধান। যৌনরোগ মানুষের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করে। ফলে সমাজে Fertility rate কমে যায়।
৯. পরিবার ভাঙন : ধর্ম, সমাজ ও আইন স্বীকৃত নিরাপদ যৌন মিলনের স্থান হচ্ছে পরিবার। পরিবারের স্বামী বা স্ত্রী অথবা উ
ভয়ে পতিতাবৃত্তির সাথে জড়িয়ে পড়লে পরিবারে এক সময় ভাঙন ধরে। স্বামীর পতিতালয়ে গমনের কারণে অনেক পরিবারই এদেশে ভেঙে গেছে।
১০. গড় আয়ু হ্রাস : পতিতাবৃত্তির কারণে সমাজে পরোক্ষভাবে হলেও জাতীয় গড় আয়ু হ্রাস পায়। পতিতাদের মাধ্যমে যেসব রোগের বিস্তার ঘটে তার ফলে মানুষ অকালে প্রাণ হারায়। এভাবে জাতীয় গড় আয়ু কমে যায়।
১১. অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি : পতিতা আইনের চোখে নিজেই অপরাধী। তাছাড়া এ বৃত্তির কারণে সমাজে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। পতিতাবৃত্তিকে কেন্দ্র করে মদ, জুয়া, অপহরণ, নারী পাচার, সন্ত্রাস, কালোবাজারি প্রভৃতি বৃদ্ধি পায়। পতিতাদের অর্থের যোগান দিতে সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজি, ছিনতাই প্রভৃতি বৃদ্ধি করে ।
১২. এতিম শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি : পতিতাদের সন্তানসন্ততির সমাজে পিতৃ পরিচয় থাকে না। তারা পিতৃ পরিচয়হীন এক নিগৃহীত জীবনযাপন করে । তাছাড়া পিতামাতা উভয়ের পতিতাবৃত্তির সাথে সংযোগ থাকলে তাদের মৃত্যুতে শিশুরা এতিম হয়ে যায়।
১৩. মানসিক চাপ বৃদ্ধি : যারা পতিতা, যারা পতিতালয়ে গমন করে; পতিতাদের বাসা ভাড়া দেয়, পতিতাদের আইনি নিরাপত্তা প্রদান করে তারা সকলে এক ধরনের মানসিক চাপের মুখে থাকে। এ ধরনের মানসিক চাপ অনেক সময় মানসিক বিকৃতি ঘটায় । পতিতারা মনোদৈহিক বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত থাকে।
১৪. উৎপাদনশীলতা হ্রাস : পতিতাদের প্রায় সকলে যুবতী। তারা সকলেই কর্মক্ষম। কিন্তু তারা কোন রকম উৎপাদনশীলতায় অংশগ্রহণ করে না। ভোগের সামগ্রী হিসেবেই সমাজে নিজেদেরকে উপস্থাপন করে। এভাবে জাতির একটা বড় অংশ উৎপাদনশীলতা হতে দূরে থেকে উৎপাদনশীলতাকে হ্রাস করে চলেছে ।
১৫. আত্মসম্মানের অবনতি : পতিতাবৃত্তি স্বাভাবিকভাবেই আত্মসম্মানের অবনতি ঘটায়। যারা পতিতা তারা সমাজে কোন সম্মান পায় না। সকলের দ্বারা তারা হেয় প্রতিপন্ন হয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের সমাজে পতিতাবৃত্তি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। রাস্তাঘাট, উদ্যান, লঞ্চঘাট, হোটেল, রেস্তোরাঁ, অফিস সর্বত্র এদের বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে বিভিন্ন কৌশলে এবং প্রয়োজনে পতিতাবৃত্তিকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। মানবিক নৈতিকতার দিকে দৃষ্টি রেখে এ ঘৃণ্য বৃত্তির বিরুদ্ধে সমাজকেই অবস্থান গ্রহণ করতে হবে।