সামাজিক স্তর বিন্যাস কি অবসম্ভাবী? আলোচনা কর ।

অথবা, সামাজিক স্তরবিন্যাসের গুরুত্ব বিশ্লেষণ কর।
অথবা, সামাজিক স্তরবিন্যাসের যৌক্তিকতা নিরূপণ কর।
উত্তরায় ভূমিকা :
স্তরবিন্যাস এবং অসাম্য পরস্পর সম্পৃক্ত। তাই স্তরবিন্যাসকে অনেক সমাজবিজ্ঞানী প্রাতিষ্ঠানিক অসাম্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। সামাজিক স্তরবিন্যাস সমাজ কাঠামোর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য যা সব সমাজেই আছে, ছিল এবং থাকবে।
সামাজিক স্তরবিন্যাস কি অবশ্যম্ভাবী : সব সমাজবিজ্ঞানীই মনে করেন যে, সামাজিক স্তরবিন্যাস বংশপরম্পরায় যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক অসাম্য। সামাজিক স্তরবিন্যাসের দুটি বৈশিষ্ট্যের কথা তারা উল্লেখ করেন। যথা :
১. সব সমাজেই অসমতা একটি সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য। অসাম্য ও উঁচুনিচু পদমর্যাদাও অবশ্যম্ভাবী
২. সামাজিক স্তরবিন্যাস স্থায়ী এবং এটা যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে। স্তরবিন্যাসের সর্বজনীনতার ব্যাখ্যায় বলা যায়, প্রতিটি সমাজ কাঠামোতে সকল ব্যক্তিকে এক একটি নির্দিষ্ট মর্যাদা এবং একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির অধিকারী হয়। এ মর্যাদার ভেদাভেদ সমাজে অসাম্যের সৃষ্টি করে যা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ.স্থানগুলো সচেতনভাবে সমাজের যোগ্যতম ব্যক্তিদের মাঝে বণ্টন করা হয় এবং এটা সমাজ কর্তৃক গৃহীত একটা কৌশল। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, সর্বজনীনতা সামাজিক স্তরায়নের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
সামাজিক স্তরায়নের সপক্ষে যুক্তি : অধ্যাপক সরোকিন তাঁর ‘Social Mobility’ গ্রন্থে বলেন যে, “Unstratified society with real equality of its members is a myth which has never been realised in the history of mankind.” তিনি বলেন যে, সামাজিক পরিবর্তন সামাজিক স্তরবিন্যাসের আকৃতি প্রকৃতিতে পরিবর্তন আনলেও এর বিলুপ্তি ঘটাতে পারে নি। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, সামাজিক স্তরবিন্যাস স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক। সরোকিন বলেন যে, “স্তরবিন্যাস ব্যবস্থা যে কোন সমাজের বৈশিষ্ট্য।” সামাজিক স্তরবিন্যাসের ক্রিয়াবাদী তাত্ত্বিকরা বলেন, কোন সমাজই শ্রেণিহীন বা স্তরবিন্যাসবিহীন নয়। এ প্রস্তাবনার ভিত্তিতেই সমাজকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ বক্তব্যের মাধ্যমেই বুঝা যায় যে, সকল সমাজেই স্তরবিন্যাস আছে এবং থাকবে। ক্রিয়াবাদী তাত্ত্বিক কিংসলে ডেভিস (Kingsley Devis), পি. এ. সরোকিন (P. A. Sorokin) এবং অন্যান্যরা সামাজিক স্তরবিন্যাস সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করেছেন। সরোকিন বলেন, বিভিন্ন পরিবেশগত অবস্থার প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিদের মধ্যে কিছু সহজাত ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতেই সমাজে সামাজিক স্তরবিন্যাস সৃষ্টি হয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। অন্যদিকে, কিংসলে ডেডিস বলেন, সমাজের কার্যগত কারণেই সামাজিক স্তরবিন্যাস দেখা যায়। সমাজে বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে। প্রতিটি কাজের গুরুত্ব অনুযায়ী উপযুক্ত লোকের হাতে দায়িত্ব দেয়া উচিত। এর উপর ভিত্তি করে ভিন্ন মাত্রার মর্যাদা ও ক্ষমতা ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায়। আর এর উপর ভিত্তি করেই সামাজিক স্তরবিন্যাসের সৃষ্টি এবং এটি চিরদিন টিকে থাকবে। সুতরাং সামাজিক স্তরবিন্যাস একটি সর্বজনীন ব্যবস্থা। অমার্কসীয়দের মতে, অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনা যেতে পারে। ব্যক্তিগত মালিকানা দিয়েও বৈষম্য সৃষ্টি হতে পারে। ক্ষমতার বণ্টন ব্যবস্থার কারণে একজন অন্যজনকে বা একগোষ্ঠী অন্যগোষ্ঠীকে আদেশ করবেই, শোষণ না থাকলেও শাসন থাকবেই। তারা বলেন, শোষক শোষিত না থাক, শাসক শাসিত সমাজ তখন স্তরায়িত হবে। তাই তারা বলেন, সমাজ সর্বজনীনভাবে স্তরায়িত। মার্কসবাদীরা উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানার উপর ভিত্তি করে সামাজিক স্তরায়নকে ব্যাখ্যা করেছেন। তারা সমাজ বিবর্তনের ইতিহাসের ধারা ব্যাখ্যা করে দেখান যে, আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে শুরু করে আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ পর্যন্ত সকল সমাজেই স্তরায়িত ছিল। প্রতিটি সমাজই স্পষ্টত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। আধুনিক পুঁ জিবাদী সমাজ মালিক এবং শ্রমিক এ দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত। কিন্তু তিনি বলেন যে, আধুনিক সাম্যবাদী সমাজ হবে শ্রেণিহীন সমাজ, যেখানে কোন শোষণ থাকবে না। কিন্তু পাশ্চাত্যের সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন যে, মার্কসীয় শ্রেণিহীন সমাজ মানে স্তরহীন সমাজ নয়, স্তরবিহীন সমাজ অকল্পনীয়। তাদের মতে, শ্রেণিহীন সমাজেও ক্ষমতা, মর্যাদা ও পেশার ভিত্তিতে স্তরবিন্যাস রয়েছে। মানুষ
তার বয়স, লিঙ্গ, পেশা, ক্ষমতা, মর্যাদা, মেধা, ভূমিকা ইত্যাদির ভিত্তিতে ভিন্ন হওয়া স্বাভাবিক। তাঁরা বলেন যে, ক্ষমতার বণ্টন ব্যবস্থা সমাজে স্তরায়ন সৃষ্টি করতে বাধ্য। একদল শাসন করবে অন্যদল শাসিত হবে, সুতরাং এ ধরনের স্তরায়ন সেই সমাজে অবশ্যম্ভাবী। তাই তারা বলেন যে, প্রতিটি সমাজই সর্বজনীনভাবে স্তরায়িত এবং এটি একটি সামাজিক সত্য।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, স্তরবিন্যাস একটি সর্বজনীন ও অবশ্যম্ভাবী ব্যবস্থা। স্তরবিন্যাস সমাজ কাঠামোর একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। মানবসমাজে উদ্দেশ্যমূলকভাবে স্তরবিন্যাস প্রবর্তিত হয় নি, বরং এটা একটা স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। সমাজ উন্নয়নের সাথে সাথে স্তরবিন্যাস ব্যবস্থায় বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন এসেছে। তবে এটি একদম বিলুপ্ত হয় নি। তবে পরিকল্পনা দ্বারা স্তরবিন্যাসের উপর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব। সুতরাং আমরা বলতে পারি যে, সামাজিক স্তরবিন্যাস সমাজ কাঠামোর অন্যতম এবং সর্বজনীন একটা বৈশিষ্ট্য.

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%b7%e0%a6%b7%e0%a7%8d%e0%a6%a0-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a6%be%e0%a6%9c%e0%a6%bf%e0%a6%95-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%a4/