উন্নয়ন পরিকল্পনায় বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ভূমিকা আলোচনা কর।

অথবা, বেসামরিক আমলাতন্ত্র কিভাবে উন্নয়ন পরিকল্পনায় ভূমিকা রাখতে পারে বলে তুমি মনে কর।
অথবা, উন্নয়ন পরিকল্পনায় বেসামরিক আমলাতন্ত্রের কার্যাবলি আলোচনা কর।
অথবা, উন্নয়ন পরিকল্পনায় বেসামরিক আমলাতন্ত্রের কী কী ভূমিকা রয়েছে?
উত্তরয় ভূমিকা :
আধুনিক সমাজব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র একটি সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। রাষ্ট্রের সকল কর্মকাণ্ডের পরতে পরতে আমলাতন্ত্র জড়িত। বিশ্বের প্রায় সকল সরকারি বেসরকারি কর্মকাণ্ডে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বিদ্যমান। জনগণের দাবি পূরণের নিমিত্তে আমলাতন্ত্র যে কোন সরকারের পূর্বশর্ত। দায়িত্ব পালনের সফলতা ব্যর্থতার উপর দেশের সকল আর্থসামাজিক কর্মকাণ্ডে সরকারের সফলতা ও ব্যর্থতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। সামরিক আমলাতন্ত্র যেমন সরকারের সফলতা ব্যর্থতার সাথে জড়িত তেমনি বেসামরিক আমলাতন্ত্রও জড়িত। তবে বেসামরিক আমলাতন্ত্র সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিভিন্নভাবে ভূমিকা পালন করে থাকে। নিম্নের বিস্তারিত আলোচনায় এটি সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

উন্নয়ন পরিকল্পনায় বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ভূমিকা (Role of civil bureaucracy to development planning) : নিম্নে আমলারা কিভাবে সেসব ভূমিকা পালন করে তার প্রকৃষ্ট কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হলো :
১. বাজেট প্রণয়নে : অনুন্নত দেশগুলোতে বাজেট প্রণয়নে আমলাদের ভূমিকাই মুখ্য। সেসব দেশে সরকারের আয়ব্যয় হিসাবনিকাশ করা থেকে আরম্ভ করে সকল বিষয়ে আমলারা ওয়াকিবহাল থাকে। সুতরাং যদিও বাজেট সরকারের নীতিনির্ধারণী বলে উল্লেখ করা হয়, কিন্তু বাস্তবে তা আমলা প্রণীত একটি দলিল মাত্র। কারণ এসব অনুন্নত দেশে যারা ক্ষমতায় আসে তাদের কোন সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক কর্মসূচি থাকে না, যা তারা ক্ষমতায় এলে বাস্তবায়ন করবে। ফলে ক্ষমতায় আসার পর তারা ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধা ছাড়া বাকি সকল বিষয়ের জন্য আমলাদের উপর নির্ভর করে।
২. অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রেও আমলাদের ভূমিকা রয়েছে। কারণ কোথায় কত অর্থ লাগবে তা নির্ভর করবে তাদের উপর। আমলার। অর্থ যোগান না দিলে অন্য কারো পক্ষে সে কাজটি করা সম্ভব নয়। তাই আমলারা যে বিষয়ে আগ্রহী সে স্থানে তারা অর্থ প্রদান করে। 15% ৩. অগ্রাধিকার নির্ণয়ে উন্নয়নে অগ্রাধিকার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। তবে দেখা যায় যে, আমলারা সেসব নীতিমালা না মেনে তাদের নিজস্ব খেয়াল অনুযায়ী কাজ করে থাকে। এতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক


৪. এলাকা নির্বাচনে : কোন এলাকা উন্নয়নের আওতায় নেয়া হবে বা কোন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডটি কোন এলাকায় করা হবে এ বিষয়ে আমলারা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এর ফলে দেখা যায় যে, যেসব এলাকার কোন ক্ষমতাধর আমলা নেই, সেসব এলাকার উন্নয়ন হয় না। যার ফলশ্রুতিতে একটি অসম উন্নয়ন ঘটতে সাহায্য করে।
৫. ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে আমলারা প্রায় সবসময়ে ঠিকাদার নির্বাচনেও সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। বিভিন্ন বিভাগের কোটি কোটি টাকার ঠিকাদারি প্রদানের ক্ষেত্রে আমলারা সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে থাকেন।
৬. আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধিতে: আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধিতে আমলাদের ভূমিকা অনন্য। পৃথিবীর সকল দেশেই আমলাদের আঞ্চলিক বৈষম্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে দেখা যায় ।
৭. উন্নয়ন অর্থ ব্যয়ে : অর্থই অনেক অনর্থের মূল। এ কথাটি কতটা সত্য সেটা ভালোভাবে বুঝা যায় উন্নয়নের আমলাদের ব্যয়ের সমীক্ষা করলে।
৮. সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টিতে : আমলারা যেসব ভূমিকা পালন করে থাকে নিম্নে তা আলোচনা করা হলো :
i. আয়কর নিরূপণে : বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে যদিও প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা প্রচলিত আছে, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, গরিব লোকদের ব্যবহার্য পণ্যের উপর যেসব পরোক্ষ কর আরোপ করা হয় তা এড়িয়ে।যাওয়ার কোন উপায় থাকে না। ফলে তাদেরকে বিশাল করের বোঝা ঠিকই বহন করতে হয়। তবে যারা দুর্নীতি করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ছে তারা এ নীতি থেকে দূরে থেকে যাচ্ছেন। ফলে সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ii. ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তিতে : ব্যাংক ঋণ পাওয়া অতি সহজ হয় যদি আমলাদের সুনজর থাকে। এটিও আবার একটি রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, ব্যাংক ঋণ পেতে গেলে কোন একজন আমলার আশীর্বাদ থাকলে সহজ হয়।
iii. ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করার ক্ষেত্রে : ব্যাংক ঋণ পাওয়া যেমন অতি সহজ যদি আমলাদের সুনজর থাকে, তেমনি আবার একটি নিয়ম দাঁড়িয়েছে যে, ব্যাংক ঋণ পেলে কোন একজন আমলার আশীর্বাদ থাকলে তা সহজে আর।ফেরতও দিতে হয় না। কারণ তারাই ঠিক করে দিবে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা লাগবে কি লাগবে না।
iv. সরকারি চাকরি প্রাপ্তিতে : সরকারি চাকরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আমলাদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন সরকারি পদে আমলাদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে অযোগ্য ব্যক্তিরা সেখানে চাকরি পাচ্ছে। ফলে সাধারণ জনগোষ্ঠীর লোক সেখানে সহজে আর চাকরি পাচ্ছে না, যা আয় বৈষম্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন সরকারি অফিসে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে আমলাদের সাথে তিন ধরনের সম্পর্ক কাজ করছে। যেমন- রক্ত সম্পর্ক, বন্ধুত্ব ও লেনদেনের সম্পর্ক।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায়, বাংলাদেশের মতো অনুন্নত দেশগুলোতে উন্নয়ন পরিকল্পনা।গ্রহণে আমলাদের ভূমিকাই মুখ্য। এসব দেশে আমলারা প্রকল্প চিহ্নিতকরণে, প্রকল্প প্রণয়নে এবং বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সাধারণত রাজনীতিবিদরা যদিও ক্ষমতায় থাকে, কিন্তু প্রশাসনের সকল স্তরে থাকে আমলা, যাদের ইচ্ছা ছাড়া কোনভাবে কোন প্রকল্প প্রস্তুত, প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।