অথবা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার উপযোগিতা আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : শিক্ষা সমাজের মৌলিক কার্যাবলির মধ্যে অন্যতম। তাছাড়া সমাজবিজ্ঞানে শিক্ষা একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবেও পরিগণিত। সব ধরনের মানবসমাজে শিক্ষাকে অন্যতম মৌল কর্মকাণ্ড বলে বিবেচনা করা হয়। বস্তুত শিক্ষা সুস্থ সমাজজীবনের চালিকাশক্তি। এর মাধ্যমে মানুষের গুণরাজ্যের নিত্যনতুন বিষয় সম্পর্কে জানা যায়। ফলে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের সাথে সাথে তার আচার আচরণেও পরিবর্তন আসে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার গুরুত্ব : শিক্ষা সমাজে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষাকে সমাজ উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক বলা হয়। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত দেশের তুলনায় নাজুক। এরূপ নাজুক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের কোন বিকল্প নেই। যার অভাবে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ও অচলাবস্থা বিরাজ করছে, এসবের সমাধান সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের মাধ্যমে সম্ভব। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার গুরুত্বসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো :
ক. পরিবর্তনশীল সমাজে শিক্ষার ভূমিকা : সমাজ নিয়ত পরিবর্তনশীল। পৃথিবীর এমন কোন সমাজ নেই, যেখানে পরিবর্তন সাধিত হয় না। তবে এ পরিবর্তন সবসময় একমুখী নয়। অর্থাৎ সমাজে পরিবর্তন অসম গতিতে চলে। অসম গতির সামাজিক পরিবর্তন সমাজে অসংগতি ও বৈষম্যের সৃষ্টি করে। বর্তমান বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা দ্বারা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রভাবিত হচ্ছে। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা অনেকটা উদার প্রকৃতির ধর্মনিরপেক্ষ পারছে না। এক শ্রেণির লোক এ শিক্ষাকে গ্রহণ করতে পারলেও দেশের বেশিরভাগ লোক একে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে সমাজের একটি শ্রেণিতে মানসিকতার পরিবর্তন হলেও অপর শ্রেণিসমূহে এ পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে না। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সমাজে অসংগতি দেখা দিচ্ছে। এরূপ অসংগতি নিরসনে দেশের শিক্ষিত যুবক ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়কে
এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য প্রয়োজন দেশের সামাজিক মূল্যবোধে ধীরে ধীরে পরিবর্তন সাধন। যেহেতু পরিবর্তন কোন আকস্মিক বিষয় নয়। এজন্য সমাজের প্রতিস্তরে পরিবর্তনের প্রভাব ও পরিবর্তনশীল অংশের উপর জানতে হবে। এবং গণতন্ত্রমনা। আমাদের সমাজের সকলে আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষাকে গ্রহণ করতে।
খ. শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা : বাংলাদেশে নগরায়ণের বিকাশ এখনো পুরোপুরি হয় নি। বেশিরভাগ লোকের বাস গ্রামে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবনকে গ্রাম যথেষ্টভাবে প্রভাবিত করে। এককথায় বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান দেশ। এদেশের বেশিরভাগ লোক (তিন চতুর্থাংশ) গ্রামে বাস করে। গ্রামের বেশিরভাগ লোক শিক্ষার আলো
থেকে বঞ্চিত। গ্রামাঞ্চলে যে সামান্য পরিসরে শিক্ষার প্রচলন ঘটেছে সেটা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই স্বল্প। তাছাড়া গ্রামের লোকেরা ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রথাপদ্ধতিকে লালন করে আসছে। গ্রামীণ শিক্ষাব্যবস্থা তাই গ্রামীণ সমাজের ঐতিহ্যের ধারক ও বাহকে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে বাংলাদেশের সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল ধর্মীয় শিক্ষাভিত্তিক। সমাজে যে শিক্ষা দেয়া হতো সেটা ছিল গতানুগতিক। সামাজিক পরিবর্তন সাধনে এ ধরনের শিক্ষা কোন ভূমিকা পালন করতো না। ব্রিটিশদের আগমনের মধ্য দিয়ে এদেশে আধুনিক শিক্ষার প্রচলন ঘটে। আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে সমাজের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এভাবে সমাজে আধুনিকতার ছোঁয়
া লাগে। তাই দেখা যায় শিক্ষা সমাজের যাবতীয় বিষয়াদির সাথে জড়িত।
প. শিক্ষাব্যবস্থার উপর কুচক্রী মহলের প্রভাব দূরীকরণ : বাংলাদেশ স্বাভাবিকভাবে একটি জনবহুল দেশ। দেশে দারিদ্র্য, বেকারত্ব, স্বাস্থ্যহীনতা, অশিক্ষা, কুশিক্ষা প্রভৃতি পূর্ণমাত্রায় বর্তমান। তাছাড়া যে সামান্য শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন আছে সেখানে বিভিন্ন কুচক্রী মহল ওঁত পেতে বসে থাকে। যে কোন রাজনৈতিক গোলযোগের সময় দেশের
বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বন্ধ হয়ে থাকা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের ছাত্রসমাজ, অচল হয়ে পড়ে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথ। তাছাড়া আমাদের পাঠ্যবইতে যেসব বিষয়ের সংযোজন ঘটানো হয়েছে সেগুলো অনেকাংশে বাস্তবতাবর্জিত।
ঘ. জনমত ও শিক্ষা : সুষ্ঠু জনমত গঠনের মাধ্যমে সমাজকে সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে পরিচালিত করা যায়। আর সুষ্ঠু জনমত গঠনে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। সুষ্ঠু জনমত গঠনের অভাবে আমাদের দেশে নির্বাচনগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় না। তাই সুষ্ঠু জনমত গঠনে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
ঙ
সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষা : আমাদের দেশে শিক্ষার অভাবে সামাজিক মূল্যবোধ বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হচ্ছে। এদেশে সন্ত্রাস, দুর্নীতি, খুন, রাহাজানি, নারীনির্যাতন, ঘুষ, মাদকদ্রব্য প্রভৃতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে। এরূপ পরিস্থিতিতে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের জন্য শিক্ষার মাধ্যমে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন।
চ. ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক : শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। কিন্তু সঠিক শিক্ষার অভাবে এ মধুর সম্পর্কে ভাঙন ধরছে। শিক্ষককে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়া, শিক্ষকের বাসভবনে হামলা আজকালকার দিনে সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সম্প্রতি হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সমাজে সুষ্ঠু শিক্ষার বিকাশ ঘটলে এরূপ ঘটা সম্ভব নয়।
ছ. ধর্মনিরপেক্ষতা ও শিক্ষা : পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ ধর্মকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছে। প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত আফগান যুদ্ধ বা ইরাক যুদ্ধ সবই
ধর্মকে বা ধর্মীয় বিষয়কে কেন্দ্র করেই সংগঠিত হয়েছে বলা যায়। আধুনিক শিক্ষা মানুষকে ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষা দেয়।
তাই সমাজে যুদ্ধের ন্যায় বিভীষিকা দূর করার জন্য শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর লোক বাস করে। তাছাড়া এদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এদেশে বিভিন্ন সমস্যা বিরাজ করছে।
এসব সমস্যা সুষ্ঠু শিক্ষা প্রণয়নের মাধ্যমে দূর করা সম্ভব। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।