অথবা, মানবজীবনে সামাজিক দলের গুরুত্ব বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীবনযাপনের জন্য দলীয় জীবন অপরিহার্য। কারণ দলীয় অভিজ্ঞতা, কার্যক্রম ও সাহচর্য প্রত্যেক মানুষের জীবনেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রত্যেককে দলীয় জীবনের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে হয় । জন্মের পর মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের বৃদ্ধি ও বিকাশের প্রতিটি পর্যায়েই দলীয় জীবন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ।
মানবজীবনে সামাজিক দলের তাৎপর্য বা প্রয়োজনীয়তা : মানুষের ব্যক্তিজীবনে ও সামাজিক জীবনে দলের ব্যাপক ভূমিকার মধ্যে যেসব উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য, নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. সামাজিকীকরণে তাৎপর্য : পৃথিবীতে মানুষ জন্ম হয় একটি ‘জীব’ হিসেবে, কিন্তু এ ‘জীবটি’ সমাজে অন্য দশজনের মতো মানুষ হয়ে উঠে দলীয় পরিবেশে। দলীয় পরিবেশে এসেই ব্যক্তিমানুষ সামাজিক মূল্যবোধ, ধ্যানধারণা, আচার আচরণ ও রীতিনীতির সাথে পরিচিতি লাভ করে ও সামাজিক হয়ে উঠে। অর্থাৎ আমরা কিভাবে মানুষ হয়ে উঠব, তা দলীয় পরিবেশে এসেই শিখি এবং আগামী দিনে কিভাবে সমাজে চলতে হবে ও জীবনকে অর্থবহ করতে হবে তা দলই শেখায়।
২. মনোভাব গঠন : দলীয় প্রভাবে ব্যক্তিমানুষের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে। দলীয় মনোভাব ও সমবেত চিন্তাভাবনা ব্যক্তির চিন্তাভাবনা ও আচরণকে প্রভাবিত করে নমুনা দান করে। আর এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েই বিভিন্ন সামাজিক ঘটনায় ব্যক্তি বিভিন্ন মনোভাব পোষণ করে।
৩. সহযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে তোলা : দলীয় জীবনের অভিজ্ঞতা সদস্যদের ভিতর সহযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে তোলে। তাতে একে অন্যের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে ও অন্যের সুখদুঃখে শরিক হয়। দলীয় জীবনে অর্জিত এরূপ সহযোগিতামূলক ভাব মানবীয় জীবনকেও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করে তোলে।
৪. ব্যক্তি প্রতিভা বিকাশের সুযোগ করে দেয় : দলীয় পরিসরে ব্যক্তিমানুষ বিভিন্ন দায়িত্ব গ্রহণ ও ভূমিকা পালনের মাধ্যমে স্বীয় প্রতিভার বিকাশ ঘটায়। তাতে ব্যক্তির মানবীয় সুকুমার বৃত্তিগুলোর স্ফুরণ ঘটে ও শক্তিসামর্থ্য বেড়ে যায়।
৫. ব্যক্তির শিক্ষণ : ব্যক্তির শিক্ষণ এবং শিক্ষণের গতি ও স্থায়িত্ব বহুলাংশেই দলীয় জীবনের উপর নির্ভরশীল তাছাড়া ব্যক্তি যে দলের সদস্য এবং যে দলে অংশগ্রহণ করে সেসব দলীয় জীবনের অভিজ্ঞতা তার সমস্যা মোকাবিলা করার পদ্ধতিকেও প্রভাবিত করে। দলীয় জীবনে অংশগ্রহণ যত বেশি হয়, ব্যক্তির শিক্ষণও তত বেশি হয়।
৬. বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক চাহিদা পূরণ : দল মানবজীবনে অনুভূত চাহিদা যেমন- স্নে, প্রেম, প্রীতি ও ভালোবাসা, অন্যের সাহচর্য, মতামত প্রকাশের ইচ্ছা ইত্যাদি পূরণ করে। ফলে ব্যক্তিজীবনে আসে প্রশান্তি ও পূর্ণতা।
৭. মানবীয় নিরাপত্তা বিধান : প্রতিকূল প্রকৃতি ও বহুমুখী সমস্যা বিজড়িত সমাজে দুর্যোগময় অনিশ্চয়তায় দলবদ্ধতা ও দলীয় সাহায্যেই নির্ভরযোগ্য আশা, ভরসার স্থল। দল অসহায় ও বিপদগ্রস্তদের নিরাপত্তা লাভে সাহায্য করে, সংকটাপন্ন অবস্থায় অস্তিত্ব রক্ষা করে ও হতাশাগ্রস্তদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
৮. মানবীয় অধিকার ও স্বার্থসংরক্ষণ : দলবদ্ধতা মানবীয় অধিকার ও স্বার্থসংরক্ষণ করে। এককভাবে আমরা যা কিছু অর্জন করতে পারি না তা দলে এসেই অর্জন করা যায়। আবার এককভাবে আমরা যা কিছু থেকে বঞ্চিত হই তা দলে এসেই আদায় করে নিতে পারি। দলবদ্ধ হয়েই আমরা শোষণ বঞ্চনার প্রতিবাদ জানাই এবং সমাজের প্রতি অধিকতর দায়িত্ব পালনের মানসিকতা লাভ করি।
৯. মানবীয় জটিলতা ও সমস্যা মোকাবিলায় সহায়তা : ব্যক্তিজীবনে অনেক জটিলতা ও সমস্যা দলীয় অভিজ্ঞতায় লাঘব হয়। দল মানসিক ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে ও মানসিক প্রশান্তি লাভের ব্যবস্থা করে।
১০. সাংস্কৃতিক জীবনের গতি বাড়িয়ে দেয় : যে কোন সমাজের মানুষের মধ্যে সংস্কৃতি চর্চা ও বিকাশে দলের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দল ব্যক্তিজীবনে সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটায়, ধারণ ও উৎকর্ষ সাধন করে এবং বিকশিত ও সম্প্রসারিত করে।
১১. নেতৃত্বের বিকাশ : সামাজিক অগ্রগতি, উন্নতি, শৃঙ্খলা এবং সংহতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সামাজিক দল। বিচ্ছিন্ন বা একাকী জীবনযাপনের মাধ্যমে নেতৃত্বের গুণাবলি অর্জন করা সম্ভব নয়।
১২. ব্যক্তিজীবনে চাওয়া পাওয়ার ভারসাম্য রক্ষা করে : দল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও লক্ষ্য নির্ধারণ করে, ব্যক্তির ক্ষমতা ও চাহিদার দ্বন্দ্ব নিরসন করে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, উক্ত ক্ষেত্রসমূহ ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে দল ও দলীয় জীবনের বিশেষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। গঠনমূলক সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি, সুশৃঙ্খলভাবে সমাজ পরিচালনা, মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা প্রভৃতি ক্ষেত্রে দলীয় জীবনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য।