কর্তৃত্বের প্রকারভেদ আলোচনা কর?

অথবা, কর্তৃত্বের শ্রেণিবিভাগ আলোচনা কর।
অথবা, কর্তৃত্বের ধরণগুলো আলোচনা কর।
অথবা, শ্রেণির ভিত্তিতে কর্তৃত্বের বর্ণনা দাও।
উত্তর৷ ভূমিকা :
আধুনিক সমাজে কর্তৃত্ব একটি বহুল আলোচিত ধারণা। কর্তৃত্বের কারণেই মানুষ আদেশ দিতে পারে, ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে এবং মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। আবার কর্তৃত্বকে স্বীকার করতে হয় বলেই মানুষ আনুগত্য প্রদর্শন করে ও হুকুম মেনে চলে। মানুষের ক্ষমতার চাবিকাঠিই হলো কর্তৃত্ব।
কর্তৃত্বের প্রকারভেদ : Max Weber কর্তৃত্বের প্রকৃতি ও প্রকারভেদ অনুযায়ী একে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যথা :
১. ঐতিহ্যবাহী কর্তৃত্ব (Traditional authority) : অতীতের প্রতি থাকে মানুষের অন্ধ আনুগত্য। আর এ অন্ধ আনুগত্যের ভিত্তিতেই সৃষ্টি হয় ঐতিহ্যবাহী কর্তৃত্বের। ওয়েবার বলেন, “রাজনৈতিক কর্তৃত্বের আদি ও সর্বজনীন রূপ হলো ঐতিহ্যবাহী কৰ্তৃত্ব।” এক্ষেত্রে মানুষ ঐতিহ্যের অনুমোদনের ভিত্তিতে তার ক্ষমতার বৈধতাকে স্বীকার করে নেয়। ক্ষমতার বৈধতার বিচারে বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ হয় না। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটেনের রাজনীতিতে রাজতন্ত্রের কর্তৃত্বের উল্লেখ করা যায়। আজও সেখানে রাজা বা রানীর কর্তৃত্ব রয়েছে। ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের যে কর্তৃত্ব তা ঐতিহ্যবাহী কর্তৃত্ব বলে বিবেচিত। এ কর্তৃত্ব বলে তিনি শুধু ব্রিটেনেই নয়, অস্ট্রেলিয়াতেও রানীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত
২. ঐন্দ্রজালিক কর্তৃত্ব (Charismatic authority) : কারো অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, আকর্ষণ ক্ষমতা, ভালোবাসা ও গ্রহণযোগ্যতা তাকে জনসাধারণের হৃদয়মন্দিরে স্থান দেয়। ফলে মানুষ তার প্রতি এক আলাদা টান অনুভব করে, আলাদাভাবে হৃদয়ে স্থান দেয়। বিভিন্ন কারণেই এটা হতে পারে। ব্যক্তিগত গুণাবলি, দেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত, সাহসিকতাপূর্ণ মনোভাব, দেশের শত্রু দমনে কৃতিত্ব, স্বাধীনতার ডাক, ব্যাপক উন্নয়ন সংস্কার, গুরুগম্ভীর ও হৃদয় জয় করা ভাষণ ইত্যাদি কারণে কোন কোন ব্যক্তি দেশের মানুষের মন সহজেই জয় করতে পারেন। এক্ষেত্রে সে ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব একটি ঐন্দ্রজালিক কর্তৃত্বের জন্ম দেয়। সবাই তার কথায় মুগ্ধ হয়, সবাই তার আদেশ মান্য করার জন্য প্রস্তুত থাকে এবং সবাই তার কথা শোনে। ব্যক্তিগত গুণের মোহিনী প্রভাবই এক্ষেত্রে কাজ করে। এভাবে ব্যক্তিগুণের ঐন্দ্রজালিক প্রভাবে যে কর্তৃত্ব সৃষ্টি হয় তাই হলো ঐন্দ্রজালিক কর্তৃত্ব। ভারতীয় উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী, চীনের মাও সেতুং ও লেলিনের
নেতৃত্বকে ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বের মধ্যে ফেলা যায়।
৩. আইনগত বা যুক্তিসংগত কর্তৃত্ব (Legal-rational authority) : আইনের কাঠামোর যে কর্তৃত্ব থাকে তাই হলো আইনগত বা যুক্তিগ্রাহ্য কর্তৃত্ব। আইনানুগ কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে আইনই ব্যক্তির কর্তৃত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। মূলত প্রশাসনিক কর্তৃত্বই হলো আইনগত কর্তৃত্ব। প্রশাসনকে সবসময় আইনের আওতায় কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে হয়। এটা সরকারি বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের বেলাতেই প্রযোজ্য। যেমন- সচিবালয়ের সচিবের যে কর্তৃত্ব তা যেমন আইনের আওতায় তেমনি কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা যখন কর্তৃত্ব প্রয়োগ করেন তাও হয় প্রাতিষ্ঠানিক আইনের আওতায়। উপর্যুক্ত তিন ধরনের কর্তৃত্ব ছাড়াও কর্তৃত্বের আরো প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন-
৪. কারিগরি কর্তৃত্ব (Technical authority) : কোন ব্যক্তি যখন বিশেষ কারিগরি জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকারী হয় তখন তাকে বলা হয় কারিগরি বিশেষজ্ঞ। যিনি কারিগরি বিশেষজ্ঞ অন্য পেশার কেউ উক্ত বিষয়ে তার মতো দক্ষতাসম্পন্ন হয় না। কাজেই উক্ত ক্ষেত্রে অন্যান্যরা সেই বিশেষজ্ঞের জ্ঞান ও দক্ষতার স্বীকার করে নেন। এ স্বীকার করে নেওয়াটাই
হলো কারিগরি কর্তৃত্ব। এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিভিত্তিক। ইচ্ছা করে এটা কেউ অন্যের উপরে চাপাতে পা রে না।
৫. মৌলিক কর্তৃত্ব (Ultimate authority) : মৌলিক কর্তৃত্বের মূল উৎস হচ্ছে কর্তৃত্বের উৎপত্তিস্থল। যেমন- রাজা, রাণী বা প্রেসিডেন্টের কর্তৃত্ব। তারা মৌলিক কর্তৃত্বে অধিকারী। স্ব-স্ব পদে থেকে তারা রাষ্ট্র
পরিচালনার কর্তৃত্ব লাভ করে।
৬. আইনানুগ আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব (Legal bureaucratic authority) : আইনানুগ আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্বের আইনই হলো কর্তৃত্বের উৎস। আইন ক্ষমতা ও কর্তৃত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। আধুনিককালের প্রত্যেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই আইনানুগ কর্তৃত্ব স্বীকৃত। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোতে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের প্রত্যেক কর্মকর্তা ও
কর্মচারীই আইনানুগ কর্তৃত্ব লাভ করেন।
৭. কার্যসম্পাদনগত কর্তৃত্ব (Operational authority) : বিভিন্ন কাজ বিভিন্ন পদাধিকারী বা বিভিন্ন ব্যক্তিকে সম্পাদনের ক্ষমতা বা কর্তৃত্ব প্রদানই হচ্ছে কার্যসম্পাদনগত কর্তৃত্ব। যেমন- একটি প্রকাশনী সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রডাকশন ম্যানেজারকে নির্দিষ্টসংখ্যক বই প্রকাশের জন্য, এডিটরদেরকে বই সম্পাদনের জন্য, হিসাবরক্ষককে কর্মচারীদের বেতন দেয়ার জন্য এবং সেলস ম্যানেজারকে বই বিক্রির জন্য কর্তৃত্ব প্রদান করতে পারেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি, কর্তৃত্ব মানবজীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কর্তৃত্ব আছে বলেই রাষ্ট্র টিকে আছে; কৰ্তৃত্ব আছে বলেই একজন আদেশ দেয় এবং অপরজনেরা তা মান্য করে। সুতরাং মানবসমাজে কর্তৃত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। কর্তৃত্ব না থাকলে কেউ কারো কথা মান্য করবে না, পৃথিবীতে সবাই যার যার মতো চলার
চেষ্টা করবে। ফলে পৃথিবী হয়ে পড়বে বিশৃঙ্খল; অশান্তির আশ্রয়স্থল ।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%95%e0%a7%83%e0%a6%a4-%e0%a6%ac/