অথবা,আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সামজিক মূল্যবোধ হ্রাসের কারণগুলো আলোচনা কর।
অথবা, বাংলাদেশে কেন সামাজিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হলো, এর পিছনের অনুঘটকগুলো আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বিশ্বের প্রতিটি সমাজের নিজস্ব কিছু স্বতন্ত্র মূল্যবোধ থাকে, যা সমাজকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করে। আর এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সমাজেও বেশ কিছু মৌলিক ও স্বতন্ত্র মূল্যবোধ রয়েছে। তবে সমাজের বিবর্তনে ও বৈশ্বিক পরিবর্তনে বর্তমানে এদেশের সামাজে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে। অফিস আদালত, রাস্তাঘাট
হাটবাজার, যানবাহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্রই এ সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
অবক্ষয়ের কারণ : দীর্ঘকাল ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ, নির্যাতন এবং স্বাধীনতাত্তোর বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশে সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় দেখা দিয়েছে। নিম্নে সংক্ষেপে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে সামাজিক মূল্যবোধের
১. অধিক জনসংখ্যা : বাংলাদেশে বর্তমানে প্রধান এবং বড় সমস্যা হচ্ছে জনসংখ্যা সমস্যা। মূলত এদেশের অধিক জনসংখ্যা প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। মাত্র ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কি. মি. এ ভূখণ্ডে বর্তমানে ১৪ কোটি ৪২ লক্ষ (অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০০৯) মানুষ বসবাস করেছে। সীমিত আয়তনের এদেশে
ব্যাপক সংখ্যক জনসংখ্যার চাপ ক্রমাগত মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। ফলে ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণে মানুষ নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে বিসর্জন দিচ্ছে।
২. অশিক্ষা : একথা সর্বজনবিদিত যে, শিক্ষা সকল উন্নয়নের মহৌষধ। অথচ আমাদের এদেশের বেশিরভাগ মানুষ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। শিক্ষাই মানুষকে উন্নত জীবনযাপনে উৎসাহ ও সুযোগ সৃষ্টি করে সভ্য হতে শেখায়। আর এ শিক্ষার স্বল্পতাই মানুষকে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের পথ সৃষ্টি করে।
৩. দারিদ্র্য : বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল একটি দেশ। দারিদ্র্য এদেশের নিত্যসঙ্গী। সম্প্রতি চালিত একটি জরিপে দেখা যায়, এদেশের প্রায় অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। মূলত বিপুলাংশের এ দরিদ্র জনগোষ্ঠী নিজের ও পরিবারের ভরণপোষণ যোগাতে সামাজিক মূল্যবোধ বিরোধী কাজকর্ম করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
৪. অসম বণ্টন ব্যবস্থা : বাংলাদেশে সম্পদ বণ্টন অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। এদেশের ৮০% মানুষ ভোগ করে মাত্র ২০% সম্পদ আর ২০% মানুষ ভোগ করে ৮০% সম্পদ। এতে করে কোন কোন শিশু প্রচুর সম্পদ ও প্রাচুর্যের মধ্যে বেড়ে উঠছে আর বেশিরভাগ শিশু দারিদ্র্য ও অবহেলোাার শিকার হচ্ছে। বস্তুত সম্পদের এ অসম বণ্টনে মাধ্যমে এক ধরনের ক্ষোভ, বঞ্চনা ও অহমিকার সৃষ্টি হচ্ছে। আর এটিই সামাজিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করছে।
৫. বেকারত্ব : বেকারত্ব মূলত মানবসমাজের একটি অভিশাপস্বরূপ। কেবল বাংলাদেশেই নয় বিশ্বের যে কোন সমাজব্যবস্থার মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ হলো এ বেকারত্ব। মূলত বেকারত্ব যুবসমাজে চরম হতাশার সৃষ্টি করে। উচ্চ শিক্ষা লাভের পরও যখন কোন ব্যক্তি যদি উপযুক্ত কর্মসংস্থানের যোগাড় করতে না পারে; স্বাভাবিকভাবে তখনই সে বেআইনি কিংবা সমাজবিরোধী কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না।
৬. মাদকাসক্তি : মাদকাসক্তির সাথে সামাজিক মূল্যবোধ অবক্ষয়ের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় মাদকাসক্তি বর্তমানে এক ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সাধারণত মাদকে আসক্ত যে কোন শ্রেণীর মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবেই যে কোন মূল্যবোধ পরিপন্থী কাজ করতে পারে।
৭. পারিবারিক কারণ : আর্থসামাজিক কারণ, চারিত্রিক দুর্বলতা, আবেগীয় বিষয়ের ফলে দম্পতিদের মধ্যে ঝগড়াও বেশি হয়। এতে
করে তারা যেমন হতাশায় ভোগে তেমনি সমস্যায় পড়ে তাদের সন্তানরা। মূলত এসব সন্তানরা তখন বিপদগ্রস্ত হয়ে নানা সমাজবিরোধী কাজকর্মে জড়িয়ে পড়ে। ফলে সামাজিক মূল্যবোধের অবনতি হয়।
৮. প্রেমে ব্যর্থতা : প্রেমে ব্যর্থতার কারণে বা প্রেমিকার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, পাচার প্রভৃতি সামজিক অবক্ষয়মূলক কাজ বেড়ে যায় ।
৯. অশ্লীল চলচ্চিত্র ও স্যাটেলাইট : সংস্কৃতির বিশ্বায়ন তথা মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির ফলে পাশ্চাত্য সমাজের অশ্লীল নাচ, যৌন উদ্রেককারী কথাবার্তা, গান প্রভৃতি এদেশের যুব সমাজকে সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত করছে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি, মনোভাব এবং সমাজ অনুমোদিত অন্যান্য ব্যবহারের সমন্বয়ে সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে উঠে। মূলত এ সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় যে কোন সমাজের জন্য একটি অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয়। এমতাবস্থায় উল্লেখিত কারণ উদ্ঘাটন করে যদি যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয় তাহলে আমাদের দেশে মূল্যবোধ অবক্ষয় এর একটা সমাধান আসবে বলে আশা করা যায়।