অথবা, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রভাব উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : অসম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন মধ্যমণি। বস্তুত যখন কোনো জাতি গোষ্ঠী অন্যান্য গোষ্ঠী থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র বলে অনুভব করে স্বশাসিত হতে চায় বা নিজস্ব রাষ্ট্র কামনা করে, তখন তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হয়। প্রত্যেক জাতির নিজস্ব রাষ্ট্র থাকার অধিকার জাতীয়তাবাদের
মূলকথা। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়েও জাতীয়তাবাদী আদর্শই ছিল মূল চালিকাশক্তি।
অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা : নিচে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ভূমিকা আলোচনা করা হলো :
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বলিষ্ঠ ও ক্যারিসমাসুলভ নেতৃত্ব দ্বারা বাঙালি জাতির মধ্যে অসম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। যেমন-
১. সকল সম্প্রদায়কে বাঙালি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধকরণ : বাংলায় বসবাসরত, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে একই জাতীয়তাবোধের পতাকাতলে দাঁড় করাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুখ্য ভূমিকা পালনকরেন। শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ফলে সকল সম্প্রদায়কে একটি প্লাটফর্মে দাঁড়
সক্ষম হন।
২. ভাষা আন্দোলন : বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে প্রথম ধাপ হলো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনকে সফল করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মর্যাদা লাভের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনে আওয়ামী লীগ যে বিশেষ ভূমিকা পালন করে তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
৩. স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন : স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু অসম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবোধ গড়ে তোলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিদের স্বার্থে এগিয়ে আসেন এবং সমস্ত বাঙালিকে নিয়ে স্বায়ত্তশাসন লাভে আন্দোলন শুরু করেন।
৪. ছয়দফা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা : বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা ছিল সমগ্র বাঙালির প্রাণের দাবি, বাঁচার দাবি। বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা দাবিতে সমগ্র বাংলার আপামর জনতা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং একটি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ফলে ছয়দফা গণমানুষের দাবিতে পরিণত হয়।
৫. গণঅভ্যুত্থান ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা : স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সমগ্র জনতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তীব্র গণ- আন্দোলন গড়ে তোলে। হিন্দু-মুসলিমসহ সকল সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্যারিসমাসুলভ নেতৃত্বের ছায়াতলে সকল বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়। একটি অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলে।
৬. ১৯৭০ সালের নির্বাচন : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের প্রচারণায় পূর্ব বাংলার সমস্ত জনগণ বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে বিপুলভাবে জয়লাভ করতে সহায়তা করে। এ বিজয়ের অন্যতম কারণ ছিল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ। যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সুদৃঢ় হয়।
৭. স্বাধীনতা যুদ্ধ : অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটে ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে। সমগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র। রেসকোর্স ময়দানে ৭ মার্চে
র ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে বলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, ইসলামের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানিরা এদেশের মুসলমান জনগণকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করবে এবং নানা প্রকার উস্কানিমূলক বাক্য উচ্চারণ করে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও একাগ্রতা নষ্ট করবে। এজন্য বঙ্গবন্ধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তথা ঐক্য বজায় রাখতে নির্দেশ প্রদান করেন। যা অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। ফলে সমগ্র বাঙালি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলমন্ত্র ছিল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ । অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে। অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছিল মুখ্য ও অপরিহার্য।