অথবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব লিখ ।
উত্তর৷ ভূমিকা :
থবা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব লিখ ।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ভূমিকা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও মুক্তিযুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাঙালিরা অংশগ্রহণ করে তবুও মুক্তিযুদ্ধে মূল নেতৃত্ব প্রদান করেছিল আওয়ামী লীগ নামক জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দলের সাথে বামপন্থি রাজনৈতিক দলসমূহ ও ছাত্র সংগঠনগুলো একত্রে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর যোগ্য নেতৃত্ব ও সহাবস্থানের ফলে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা লাভ করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা : মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন মতাদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমন্বয় সাধিত হয়। মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল এবং জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলগুলো মাতৃভূমিকে মুক্ত করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিচে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা উল্লেখ করা হলো। যথা :
১. আওয়ামী লীগের ভূমিকা : আওয়ামী লীগ দল বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। মূলত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তানি শাসনামলে আওয়ামী লীগ দল মুসলিম লীগের বিপক্ষে বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দলটি পূর্ব বাংলার সর্বাধিক জনপ্রিয় দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের গণমানুষের অধিকার আদায়ে এ
দলটি সবসময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ দল পূর্ব বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রতিনিধি হয়ে উঠে।
১৯৬৯ সালে আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলে, যার পরিণতিতে আইয়ুব খানের পতন ঘটে। আইয়ুব খানের পতনের পর আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, যা ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তান সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় দলটি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়। আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলনে বাঙালিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধকে সার্থক ও সাংগঠনিক রূপ দিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১০
এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করে। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ, পাকবাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা, শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানে মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহ, বহির্বিশ্বে জনমত গঠন ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন লাভ করতে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগসহ সর্বস্তরের জনতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের আদর্শ, মূল্যবোধ ও দক্ষ নেতৃত্বের ফলেই মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়।
২. মস্কোপন্থি বামদলগুলোর ভূমিকা : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়া সর্বতোভাবে সহায়তা করে। বাংলাদেশে কিছু কিছু বামপন্থি দল মস্কোপন্থি ছিল। বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফ্ফর) এবং সংগঠনসমূহ হলো কৃষক সমিতি, ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি। বামপন্থি দলগুলো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকবাহিনীর
বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। বামপন্থি দলগুলো গেরিলা যুদ্ধে সফলতা অর্জন করে। ভারত থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বামপন্থি দল
গুলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে। মস্কোপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সমর্থন জানিয়ে রাশিয়া মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন প্রদান ও জনমত গঠন করেছিল ।
৩. পিকিংপন্থি রাজনৈতিক দলের ভূমিকা : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে চীন সরাসরি বিরোধিতা করে এবং পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। তবে চীনাপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী), বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি, কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র, কমিউনিস্ট ওয়ার্কার্স এসোসিয়েশন প্রমুখ চীনাপন্থি দলের ভূমিকা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। চীনাপন্থি হওয়ার কারণে এ সকল দলগুলো মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও রাশিয়ার কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতা লাভে ব্যর্থ হয়। ভাসানী চীনা নেতাদেরকে অনুরোধ
করেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ নিতে কিন্তু সে অনুরোধ চীনা নেতারা রাখেননি। তারপরেও চীনাপন্থি দলগুলো বিচ্ছিন্নভাবে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করতে থাকে।
৪. ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল (ডানপন্থি) : বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনতা যুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করে। তারা পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সাহায্য সহযোগিতা করে। এ দলগুলোর হলো মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, পিডিপি প্রভৃতি। এ সকল দল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, দখলদারিত্বের মতো অসংখ্য ঘৃণ্য কার্যে লিপ্ত হয়। ধর্মভিত্তিক অঙ্গসংগঠন শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল-শামস্, আল-বদর সংগঠনগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পাকবাহিনীর কাছে পৌঁছে দিত। প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় লিপ্ত হয় এ সংগঠনগুলো। ধর্মভিত্তিক দলগুলো পাকিস্তান রক্ষায় নির্বিচারে যুদ্ধাপরাধ করতে থাকে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগ দল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে। স্বাধীনতা যুদ্ধে আওয়ামী লীগের বিকল্প নেতৃত্ব ছিল না। বামপন্থি দলগুলো আওয়ামী লীগের সাথে একত্রিত হয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়। অন্যদিকে, ডানপন্থি
ধর্মভিত্তিক দলগুলো পাকিস্তান রক্ষার নামে খুন, ধর্ষণ, লুটপাট, গণহত্যা চালায় নিরীহ বাঙালিদের উপর। ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর যুদ্ধাপরাধের দায়ে বাংলার মাটিতে বিচার হচ্ছে। সুতরাং প্রগতিশীল দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ নেয় আর প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলো মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে প্রগতিশীল প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলের বিজয় হয়। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়।