সামরিক ঘাটতি পূরণ : প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য সরকারকে নিয়মিত অর্থ ব্যয় করতে হয় । কিন্তু সরকার নিয়মিতভাবে আয় পায় না । ফলে সরকারের আয় – ব্যয়ে অর্থের ঘাটতি পড়ে । এরূপ সাময়িক ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করতে হয়। সরকার ঋণ গ্রহণ করে থাকেন দেশ সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য এবং দেশের উন্নয়নের জন্য ৷.
সরকারি ঋণ কী?
What is Public Debt?
সরকারি ঋণ বলতে দেশের সরকার কর্তৃক গৃহীত ঋণকে বুঝায় । কোন দেশের সরকার যদি দেশের অভ্যন্তরে ব্যক্তি বিশ্লেষ বা প্রতিষ্ঠানের নিকট হতে কিংবা বিদেশ হতে ঋণ গ্রহণ করে তবে তাকে সরকারি ঋণ বলা হয় । বর্তমান যুগে জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্য সরকারকে বহুবিধ কাজ সম্পাদন করতে হয় । এর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের দরকার হয় । সরকার বিভিন্ন উৎস হতে যে রাজস্ব বা আয় পায় তা দ্বারা অনেক সময় এসব ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হয় না । এ অবস্থায় সরকার দেশের অভ্যন্তরে কিংবা বিদেশ হতে ঋণ গ্রহণ করে জনকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়ন করে থাকে । সুতরাং বর্ধিত জাতীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য কোন দেশের সরকার ঋণ পত্র বিক্রয় করে অথবা অন্য কোন উপায়ে দেশের অভ্যন্তরে কিংবা বিদেশ হতে যে ঋণ গ্রহণ করে তাকে সরকারি ঋণ বলা হয় । সরকার দেশের মধ্যে জনগণের নিকট বা সংস্থা হতে কিংবা বিদেশি সংস্থা অথবা বিদেশি সরকারের নিকট হতে ঋণ গ্রহণ করে।
Findlay Sirass এর মতে , ” National debt is a debt which a state owes to its subjects or nationals of the countries.”
পরিশেষে বলা যায় সরকার কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত ঋণকে সরকারি ঋণ বলে চিহ্নিত করা হয়।
সরকার ঋণ গ্রহণ করে কেন ? Why does the Government Borrow ?
প্রত্যেক দেশের সরকার জাতীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য বিভিন্ন উৎস হতে রাজস্ব সংগ্রহ করে । কিন্তু সংগৃহীত রাজস্ব দ্বারা অনেক সময় সরকারি ব্যয় মিটান সম্ভব হয় না । এ অবস্থায় সরকারকে ঋণ গ্রহণ করতে হয় । নিয়ে সরকারের ঋণ গ্রহণের বিভিন্ন কারণ আলোচনা করা হলো :
১. সামরিক ঘাটতি পূরণ : প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য সরকারকে নিয়মিত অর্থ ব্যয় করতে হয় । কিন্তু সরকার নিয়মিতভাবে আয় পায় না । ফলে সরকারের আয় – ব্যয়ে অর্থের ঘাটতি পড়ে । এরূপ সাময়িক ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করতে হয়।
২. জরুরি অবস্থা মোকাবিলা: অর্থনীতিতে জরুরি অবস্থা দেখা দিলে তা মোকাবিলা করতে তড়িঘড়ি করে চিরাচরিত উৎস থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়ে উঠে না । অর্থনীতিতে জলোচ্ছ্বাস , ভূমিকম্প , বন্যা , দুর্ভিক্ষ , মহামারী , যুদ্ধ বিভিন্ন রকম অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে । যা কোন নিয়ম মাফিক বিষয় নয় । এরূপ অবস্থা মোকাবিলার জন্য সরকার রাজস্ব প্রাপ্তির আশায় অপেক্ষা করতে পারে না । তাছাড়া রাজস্ব আয় দ্বারা এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করাও সম্ভব নয় । কাজেই জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য সরকারকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়।
৩. ঘাটতি বাজেট পুরণ : সরকারের বাজেটে আয় অপেক্ষা ব্যয় বেশি হলে তাকে ঘাটতি বাজেট বলা হয় । অনেক সময় সরকারের আয় অপেক্ষা ব্যয় বেশি হয় । ফলে বাজেটে ঘাটতি দেখা দেয় । বাজেটের এরূপ ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
৪. সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো গঠন : অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সুদৃঢ় সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন । সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো বলতে শিক্ষা , স্বাস্থ্য , পানি , বিদ্যুৎ , পরিবহন ও যোগাযোগ ইত্যাদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়ক বিষয়ের উন্নয়ন সাধনকে বুঝায়। এসবের উন্নয়নের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয় । সরকারকে ঋণ গ্রহণ করে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো গঠন ও এদের উন্নয়নের ব্যবস্তা করতে হয়।
৫. যুদ্ধ ব্যয় নির্বাহ : অনেক সময় এক রাষ্ট্রের সাথে অন্য রাষ্ট্রের যুদ্ধ বাধে । তাছাড়া বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই সবসময় লক্ষ্য করা যায় । কাজেই সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা ও যুদ্ধের বায় নির্বাহ করার জন্য প্রচুর অর্থের দরকার হয় । জনগণের উপর কর ধার্য করে এ জাতীয় ব্যয় নির্বাহ করা মোটেই সম্ভব নয় । সুতরাং যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ , সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালীকরণ প্রভৃতির দরুন সরকারকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়।
৬. মন্দাভাব দূরীকরণ : অর্থনীতিতে অনেক সময় মন্দাভাব দেখা দেয় । এসময় জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায় । ফলে দ্রব্যসামগ্রীর চাহিদা অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পায়। এতে শিল্প প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং অসং শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে । এরূপ অবস্থায় অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবনের জন্য সরকারকে বিনিয়োগ বাড়াতে হয়। মন্দার সময় জনসাধারণের আয় কমে যাওয়ায় করের মাধ্যমে অর্থের সংস্থান করা সম্ভব হয় না। সুতরাং সরকারকে ঋণ গ্রহণ করে বিনিয়োগ বাড়াতে হয়। এতে অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার হয় , অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পায় এবং মন্দাভাব দূরীভূত হয়।
৭. দেশের সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি : সরকারি ঋণ বেসরকারি বিনিয়োগের সবচেয়ে নিরাপদ ক্ষেত্র। সরকার বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র যেমন- প্রাইজবন্ড , প্রতিরক্ষা সঞ্চয় পত্র , বোনাস সঞ্চয় পত্র , ওয়েজ আর্নার বন্ড , ট্রেজারি বিল ইত্যাদি জনগণের মধ্যে বিক্রি করে ঋণ গ্রহণ করে। এসব ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে জনগণের সঞ্চয় প্রবণতা ও বিনিয়োগ প্রবণতা বেড়ে যায় , যা উন্নয়নশীল দেশের সরকারকে ঋণ গ্রহণ করতে উৎসাহিত করে।
৮. কল্যাণমূলক কর্মসূচির বাস্তবায়ন : দেশের জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্য সরকারকে অনেক কল্যানমূখী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হয়; যেমন- শিক্ষা , জনস্বাস্থ্য , দরিদ্র জনগণের মধ্যে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধ প্রদান , খাবার পানি সরবরাহ বৃদ্ধ বয়সে পেনশন , বেকার ভাতা , দুর্যোগের সময় সাহায্য দান ইত্যাদি। এসব কল্যাণমূলক কাজ সম্পাদনের জন্য সরকারের বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। এসব ব্যয় মেটানোর জন্য সরকার ঋণ গ্রহণ করে।
৯. মুদ্রাস্ফীতি রোধ : মুদ্রাস্ফীতির ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় । এতে সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্ট বাড়ে এবং অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতা ব্যাহত হয়। এ অবস্থায় দেশের মধ্যে যাদের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ আছে তাদের নিকট হতে সরকার ঋণ গ্রহণ করে। ফলে বাজারে অর্থের প্রচলনের গতি হ্রাস পায় , জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায় এবং মুদ্রান্কীতি রোধ করা সম্ভব হয়।
১০. আয় বৈষম দূরীকরণ: সরকার দেশের সম্পদশালী লোকদের নিকট হতে ঋণ গ্রহণ করে দরিদ্র জনসাধারণের কল্যাণকর ও দেশের উন্নয়নমূলক কাজে অর্থ ব্যয় করতে পারে। ফলে সমাজে ধনী ও দরিদ্রের আয় বৈষম্য অনেকাংশে দূর হয়।
১১. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় । এর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জাতীয় আয় খুবই কম । তাই দেশে মূলধন দুষ্প্রাপ্য। এ অবস্থায় সরকারকে দেশ ও বিদেশ হতে ঋণ গ্রহণ করে পরিকল্পনার ব্যয় নির্বাহ করতে হয়।
উপর্যুক্ত আলোচনা হতে দেখা যায় যে , সরকারকে বহুমুখী কাজ সম্পাদনের জন্য ঋণ গ্রহণ করতে হয়। দেখা যায় যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশসমূহের জনসাধারণ অত্যন্ত দরিদ্র এবং এসব দেশে সম্পদের পরিমাণ খুবই কম। কাজেই দেশের ক্রমবর্ধমান সমস্যাবলির সমাধান তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সরকারকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। সরকারি ঋণের উপযুক্ত ব্যবহারের ফলে দেশে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব হয় । ফলে উৎপাদন বাড়ে এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির হার ত্বরান্বিত হয়। তবে ঝণের ব্যবহার সম্পর্কে সরকারের সতর্কতা অবলম্বন করা বিশেষ দরকার।
সরকারি ঋণের উৎসসমূহ Sources of Public Debt
সরকার সাধারণত স্বাভাবিক উৎস হতে প্রাপ্ত আয় দ্বারা ব্যয় নির্বাহ করে থাকে । কিন্তু ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটানোর জন্য অনেক সময় তার আয় পর্যাপ্ত বিবেচিত হয় না । এ অবস্থায় সরকারকে ঋণ গ্রহণ করতে হয় । সরকার বিভিন্ন উৎস হতে ঋণ গ্রহণ করে । এসব উৎসকে প্রধানত দু’ভাগে ভাগ করা যায় । যথা :
ক . অভ্যন্তরীণ উৎস ও
খ . বৈদেশিক উৎস।
নিম্নে সরকারি ঋণের এসব উৎসের আলোচনা করা হলো:
ক . অভ্যন্তরীণ উৎস (Internal sources): অভ্যন্তরীণভাবে সরকার কতকগুলো উৎস হতে ঋণ গ্রহণ করে। এগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো :
১. ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ : সরকার ব্যক্তির কাছ থেকে বন্ড বিক্রি করে ব্যক্তির ভোগ হ্রাস অথবা সঞ্চয় বৃদ্ধি করতে পারে। ব্যক্তির বন্ড ক্রয়ের ফলে ভোগ বা ব্যবসায়িক বিনিয়োগের উপর খুব বেশি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না। সাধারণত জনগণ তাদের অলস তহবিল দ্বারাই এরূপ বন্ড ক্রয় করে। সরকার এভাবে সংগৃহীত অর্থ তার বাজেটের ঘাটতি পূরণে ব্যবহার করতে পারে।
২. আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ : সরকার বিভিন্ন অআর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে । যেমন Insurance কোম্পানি , বিনিয়োগ ট্রাস্ট , সঞ্চয়ি ব্যাংক ইত্যাদি । সরকার এদের কাছ থেকে বন্ড বিক্রি করে অলস অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠানসমূহ সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করতে বেশি আগ্রহী থাকে। কারণ সরকারি বস্তু সম্পূর্ণ ঝুঁকিহীন এবং উচ্চ তারল্যতা বিদ্যমান থাকে।
৩. বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ : বাণিজ্যিক ব্যাংকের হাতে অনেক অব্যবহৃত অর্থ থেকে যায় । সরকার এসব ব্যাংকের কাছে বন্ড বিক্রি করে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করতে পারে । অনেক সময় সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে বন্ড ক্রয় করতে বাধ্য করে। বাণিজ্যিক ব্যাংক বহুগুণ ঋণ সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় যে অতিরিক্ত ক্যাশ রিজার্ভ সৃষ্টি করে তার মাধ্যমে সরকারি বন্ড ক্রয় করতে পারে।
৪. কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ : কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের ব্যাংক । তাই সরকার কোন সময় ঘাটতির সম্মুখীন হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের বন্ড ক্রয় করে সরকারের খাতে অর্থ জমা দেয়। সরকারের চেক বহনকারী যে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই অর্থ সংগ্রহের সুযোগ পায় ।
খ . বৈদেশিক উৎসসমূহ : সরকার দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বৈদেশিক উৎস হতে ঋণ গ্রহণ করতে পারে । নিম্নে সরকারি ঋণের বৈদেশিক উৎসসমূহ আলোচনা করা হলো :
১. বিদেশি ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ : সরকার বিদেশি কোন ব্যক্তির কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে , বিদেশি কোন ব্যক্তি বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ধরনের বন্ড ক্রয় করে সরকারকে ঋণ দিতে পারে । যদি সরকারি বন্ড ক্রয়ে দেশি ও বিদেশি নাগরিকদের মধ্যে কোন বাধ্যবাধকতা না থাকে তাহলে ব্যক্তির কাছ থেকে সহজেই ঋণ গ্রহণ করা যায়।
২. সংস্থার কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ : সরকার বিদেশি বিভিন্ন ধরনের সেবা সংস্থার কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে।
৩. আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান: সরকার আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন- সরকার বিশ্ব ব্যাংক ( WB ) , আন্তর্জাতিক অর্থতহবিল ( IMF ) , আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ( IDA ) , এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক ( ADB ) প্রভৃতি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে ঋণ গ্রহণ করতে পারে । সরকার দেশের বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি সমস্যা দূরীকরণের জন্য স্বল্পমেয়াদি এবং উন্নয়নমূলক কাজের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করে।
৪. বিদেশি সরকার : সরকার অনেক সময় বাজেটে ঘাটতি পূরণের জন্যও উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় নির্বাহের জন্য বিদেশি সরকারের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে । এরূপ ঋণ বিভিন্ন ধরনের শর্তসাপেক্ষ।
সরকারি ঋণ কী ভারহীন ?
Is Puplic Debt Burdenless?
ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদগণ বিশ্বাস করতেন সরকারি ঋণ অর্থনীতির জন্য খুব একটি প্রয়োজন নেই বরং যে করেই হোক ঋণ পরিহার করাই উত্তম । কারণ সরকারি ব্যয় সবসময় অপচয়মূলক। যে কারণে ক্লাসিকেল অর্থনীতিবিদগণ ঋণ গ্রহণের পক্ষপাতি ছিলেন না। এক ব্যক্তির সঞ্চয় অপর ব্যক্তির ঋণ । তথা ব্যক্তিক বা সংস্থার সঞ্চয়ই সরকারের ঋণ। ব্যক্তি বা সংস্থার সঞ্চয় সরাসরি উৎপাদনের কাজে লাগাতে পারে । কিন্তু সরকার সেই সঞ্চিত অর্থ সংগ্রহ করে যদি অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করে তা অর্থনীতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না বরং অকল্যাণের প্রভাব ফেলতে পারে । যে কারণে ক্লাসিকেল অর্থনীতিবিদদের মতে সরকারি ঋণ ভারহীন নয় ।
E.D. Domar এর মতে , সরকারি ঋণেরই শুধু ভার নেই , সুদ পরিশোধেরও ভার রয়েছে। সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে জনগণের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করতে হবে , যা অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। ক্লাসিক্যালদের মতে ঋণ যদি করতেই হয় তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা পরিশোধ করা উচিত। ক্লাসিক্যালদের ধারণা সরকারি ব্যয় যুদ্ধ পরিচালনা ও রাজ্যের প্রজাবর্গের বিলাসবহুল জীবনযাপনের জন্য ব্যবহৃত হয় বলে এগুলো অনুৎপাদনশীল । অথচ ঝণের অর্থ এবং সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে জনগণের কাছ থেকে উচ্চহারে কর আদায় করতে হয়। যে কারণে করের বোঝা সমস্ত নাগরিকরা বহন করে। তাই সরকারি ঋণ ভারযুক্ত , ভারহীন নয় । কেইন্সীয় অর্থনীতিবিদগণ সরকারি ব্যয়কে অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেছেন । সরকারি ঋণ যেহেতু সরাকরি ব্যয়কে প্রসারিত করে তাই দেশের অভ্যন্তর থেকে সংগৃহীত ঋণ অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে । ফলশ্রুতিতে সরকারি ঋণ ভারহীন , তথা কোন ভার নেই । সরকারি ঋণের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে আয় , বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে শুভ প্রভাব রচনা করে । বর্ধিত আয় থেকেই পরবর্তীতে ঋণ পরিশোধ করা যেতে পারে । জনগণের কাছ থেকে সরাসরি অর্থ সংগ্রহ না করেও ঋণ পরিশোধ করা যায় । যে কারণে সরকারি ঋণ ভারহীন।
পরিশেষে বলা যায় , সরকারি ঋণ ভারহীন কি না তা নির্ভর করে ঋণের উদ্দেশ্য , ঋণ কিভাবে ব্যয় করা হয় এবং ঋণের শর্ত কিরূপ তার উপর।
সরকারি ঋণ ও বেসরকারি ঋণের মধ্যে পার্থক্যসমূহ
১. ঋণ গ্রহণ পদ্ধতি: ব্যক্তি তার প্রয়োজনে অন্য ব্যক্তি , সংস্থা বা ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে । তবে এই ঋণের ক্ষেত্রে অনেক সময় জামানত রাখা বাধ্যতামূলক । ব্যক্তি এ ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন রূপ শক্তি প্রয়োগ করতে পারে না । অনুরোধ উপরোধের মাধ্যমে ঋণ গ্রহণ করে । অন্যদিকে সরকার দেশের জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় বাধ্যতামূলক ভাবে জনগণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে । এর বিনিময়ে কোন সমমূল্যের সম্পদ জামানাত রাখা হয় না । তবে লিখিত কাগজ প্রদান করা হয়।
২. ঋণের উৎসে পার্থক্য : সরকার দেশের জনগণের নিকট থেকে , দেশীয় ব্যাংকসমূহের নিকট থেকে এবং বিদেশি সরকার , সংস্থা , আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে । কিন্তু ব্যক্তি শুধু আত্মীয় স্বজন , বন্ধু – বান্ধব , লগ্নী ব্যবসায়ী ও গুটি কয়েক ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারে । অর্থাৎ সরকারের ঋণের উৎস প্রশস্ত এবং ব্যক্তির ঋণের উৎস সীমিত।
৩. ঋণের মেয়াদ : ব্যক্তির ঋণ সবসময়েই স্বল্পমেয়াদি কিন্তু সরকারের ঋণ দীর্ঘমেয়াদি । ব্যক্তি বেঁচে থাকা অবস্থায় ঋণ পরিশোধ করে কিন্তু সরকার চিরজীবী । তাই এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকৃতির । ব্যক্তি দীর্ঘমেয়াদি ঋণ গ্রহণ করলে তা জীবদ্দশায় পরিশোধ করতে না পারলে সন্তান সন্ততিদের উপর বর্তায় , যা যুক্তিসংগত নয়।
৪. ঋণ অস্বীকার করা : রাষ্ট্র ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অনেক সময় সংকটে পড়ে ঋণ অস্বীকার করতে পারে । এর ফলে ঋণদাতা ঋণের অর্থ ফিরে পায় না । দেশে কোন বিপ্লব হলে পূর্ববর্তী সরকারের গৃহীত ঋণ অস্বীকার করতে পারে । কিন্তু ব্যক্তি এ ধরনের ঋণ অস্বীকার করতে পারে না । আইনগতভাবে ব্যক্তি ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য থাকে। তবে ব্যক্তি যদি পাগল বা দেউলিয়া হয় তাহলে ঋণ থেকে অব্যাহতি পেতে পারে।
৫. ঋণ পরিশোধের উপায়: ব্যক্তি তার ঋণ পরিশোধের জন্য অতীতের সঞ্চয় , বর্তমান আয় , সম্পত্তি বিক্রয় বা নতুন ঋণের আশ্রয় নিতে পারে । কিন্তু সরকার ঋণ পরিশোধের জন্য ( ক ) নতুন কর আরোপ ( খ ) নতুন ঋণ সংগ্রহ ( গ ) নতুন মুদ্রা সৃষ্টি এবং ( ঘ ) বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করতে পারে। তাই সরকারের ঋণ পরিশোধের উৎস এবং ব্যক্তির ঋণ পরিশোধের উৎস এক নয়।
৬. ঋণ প্রদানে বিশ্বাস : ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির বিশ্বাস পুরোপুরি থাকে না ; তাই ব্যক্তিকে ঋণ গ্রহণ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় । কিন্তু সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা থাকে । যে কারণে সরকার সহজেই ঋণ গ্রহণ করতে পারে । জনগণ সরকারকে ঋণ প্রদান করে কারণ সরকারি ঋণ ঝুঁকিমুক্ত।
৭. সরকারি ঋণের ফল : সরকারি ঋণের ফল সমাজে সবাই ভোগ করে । এমন কি ঋণদাতারাও সরকারি ঋণের ফল ভোগ করে । কেননা সরকারি ঋণ উন্নয়নমূলক খাতে ব্যয় করলে সে বায়ের ফল দেশের প্রতিটি নাগরিক ভোগ করে । অন্যদিকে ব্যক্তিগত ঋণের ফল ব্যক্তি একাই ভোগ করে। ঋণদাতা কোন সময়ই ঋণের বিপরীতে কোন কল্যাণ পায় না।
৮. ঋণ গ্রহণে অভ্যস্ততা: ব্যক্তি ঋণ গ্রহণে অভ্যস্ত নয়। তার আয় ব্যয়ের চেয়ে বেশি হলে বা সমান হলে ঋণ গ্রহণ করে না। কিন্তু সরকারের ঘাটতি বাড়তি যাই হোক ঋণ গ্রহণ করতে পারে। মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিলে সরকার ঋণ গ্রহণ করে জনগণের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস করে। আবার মুদ্রাসংকোচন দেখা দিলে ঋণ করে অর্থ ব্যয় করে বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করতে পারে।
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায় যে , সরকারি ও বেসরকারি ঋণের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে।