অথবা, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানিদের পরাজয়ের কারণ সম্পর্কে যা জান লিখ।
উত্তর৷ ভূমিকা : ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শত্রুদের কার্যক্রম প্রতিহত করতে প্রথমই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালি ছাত্র, যুবক, জনতার পাশাপাশি বাঙালি নিয়মিত সৈনিক, ইপিআর, আনসার পুলিশ প্রভৃতি। ডিসেম্বরের প্রথম থেকে সর্বাত্মক ও চূড়ান্ত যুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানিদের পরাজয়ের কারণ : ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানিদের পরাজয়ের ৫টি কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো :
১. ভৌগোলিক বৈপরীত্য : দ্বিজাতি তত্ত্বের মাধ্যমে ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্তি হয় এবং পাকিস্তানের জন্ম হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে শুধু ধর্মীয় দিক ছাড়া সর্বদিকে ছিল বিস্তর ব্যবধান। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব ছিল প্রায় ১৬০০ কি. মি.। তিনদিকে ভারত একদিকে বঙ্গোপসাগর এবং দক্ষিণ-পূর্ব কোণ বার্মা। অসংখ্য নদনদী এবং পূর্ব বাংলায় জনসমর্থন না থাকায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে সফল হতে পারেনি। ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার কারণে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের অন্যতম কারণ।
২. গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতি : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছিল। সুযোগ বুঝে অতর্কিতভাবে আক্রমণ করে গেরিলা বাহিনী দ্রুত পলায়ন করত। বাংলাদেশে বেশিরভাগ গ্রাম বনজঙ্গল, পাহাড়, মাঠ নদী দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় গেরিলারা সহজে এবং দ্রুত আক্রমণ করতে পারত। গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ পাকিস্তানি বাহনীর মনোবল ভেঙে দেয়।
৩. পাকিস্তানিদের অন্তর্দ্বন্দ্ব : পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ ও সামরিক জেনারেলদের মধ্যে ঐক্য ছিল না। পাকিস্তান পিপলস পার্টি, মুসলিম লীগ, জামায়েত ইসলামী, পিডিপির মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল প্রকট। ফলে রাজনৈতিক দল ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে মতভেদ থাকায় যুদ্ধে সফলতা অর্জনে ব্যর্থ হয়।
৪. জলবায়ুগত প্রভাব : পশ্চিম পাকিস্তান মূলত উষ্ণবায়ু অঞ্চলের দেশ। পাকিস্তানে তুলনামূলক বৃষ্টি কম হয়। কিন্তু বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। মে – সেপ্টেম্বর মাস মূলত বর্ষাকাল। বর্ষাকালে পাকিস্তানি সৈন্য ও সরঞ্জাম, বহন ও চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে পাকিস্তানি সৈন্যদের নৈতিক মনোবল ও কায়িক শক্তির অপচয় হয়। যা পাকিস্তানের পরাজয় ডেকে আনে।
৫. যৌথবাহিনীর রণকৌশল : যৌথবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর তিনভাবে আক্রমণ শুরু করে। সেনা, নৌ ও৷ বিমান আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। ফলে মাত্র ১৩ দিনেরে মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের জন্য বহুবিধ কারণ বিদ্যমান ছিল। এদের ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, জনমত, অর্থসংকট, রণকৌশল প্রভৃতি কোনটিই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অনুকূলে ছিল না। সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিবেশ পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। ফলে তাদের পরাজয় নিশ্চিত হয়।