অথবা, স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট কী ছিল? বর্ণনা কর।
উত্তরা৷ ভূমিকা : বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ দেশের মুক্তি সংগ্রামের মাইলফলক ও প্রেরণার উৎস ছিল স্বাধীনতা ঘোষণা। স্বাধীনতা ঘোষণার পিছনে ছিল দীর্ঘদিনের শোষণ, নির্যাতন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুক্তির ঘোষণা। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭০ সালের নির্বাচন পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের উপর সুপরিকল্পিতভাবে বৈষম্য ও দমননীতি গ্রহণ করে তাই এ নির্যাতন থেকে মুক্তির পথ ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা।
স্বাধীনতার ঘোষণা : ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহর বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর নিকট পাঠান এবং সেখান থেকে আওয়ামী লীগ নেতা মো. আব্দুল হান্নান প্রচার করে। পরবর্তীতে ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। নিচে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হলো :
১. বাঙালিদের উপর শোষণ ও নির্যাতন : ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর নির্ভর করে ভারত বিভক্তি হয় এবং জন্ম হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের। পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী শুরু থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে দমন করে রাখার অপকৌশল গ্রহণ করে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সর্বক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তান বাঙালিদের শোষণ করতে থাকে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের ইচ্ছা পূর্ব পাকিস্তানের উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে থাকে। মূলত পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত করে। যার থেকে মুক্তি পাবার জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
২. জনগণের রায় উপেক্ষা : ১৯৬৯ সালে স্বৈরাচারী আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয় এবং তার স্থলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন ইয়াহিয়া খান। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি ঘোষণা দেন ১৯৭০ সালে নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে কিন্তু আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করলে পাকিস্তানের সামরিক সরকার আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। বিভিন্ন টালবাহানা শুরু করে। জনগণের রায়কে উপেক্ষা করে গণরায়কে বানচাল করার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র শুরু করে।
৩. ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা : ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। বঙ্গবন্ধু বৈধ ক্ষমতার অধিকারী হয়। কিন্তু সামরিক সরকার আওয়ামী লীগের এ বিজয়ে বিচলিত ও ভীত হয়ে পড়ে। তারা আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি ছিল না। সামরিক সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতা
হস্তান্তরে অনীহা প্রকাশ করে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা করেন। ফলে পিপিপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চরমে উঠে। যার ফলে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
৪. ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র ও ক্ষমতা লিপ্সা: পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী ‘৭০ এর নির্বাচনে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বৈধ দাবিদার। কিন্তু ভুট্টো ও ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পক্ষপাতি ছিল না। তারা নানারকম ষড়যন্ত্র শুরু করে ভুট্টো আওয়ামী লীগকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করতে চায় । ইয়াহিয়া খান ও পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগকে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা প্রদানে ইচ্ছুক ছিল না। ফলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কাল
ের জন্য স্থগিত করেন। এরূপ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
৫. ৭ মার্চ এর ভাষণ : অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ভাষণ প্রদান করেন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে। সেখানে বিপুলসংখ্যক জনতা ধীনতার দাবিতে একত্রিত হয়। বঙ্গবন্ধু এ ভাষণে জনতাকে মুক্তি সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে বলেন। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি।
৬. ২৫ মার্চ এর গণহত্যা : দীর্ঘ আলাপ আলোচনার পরেও রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয় পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খান। জুলফিকার আলী ভুট্টো ছয়দফাকে মানতে অস্বীকৃতি জানায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয়দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে থাকে অটল। ফলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বৈধ ক্ষমতার অধিকারী আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা প্রদান না করে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা সহ সারাদেশে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির উপর নৃশংস গণহত্যা শুরু করে। অপারেশন সার্চলাইট নামে সামরিক অভিযানে হাজার হাজার বাঙালি হত্যা করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পরিস্থিতি উপলব্ধি করে গ্রেপ্তারের পূর্বমুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা পূর্ব পাকিস্তানের জনতার মধ্যে টনিক হিসেবে কাজ করেছিল। সর্বস্তরের জনতা এ স্বাধীনতা ঘোষণার সমর্থন জানিয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। যার ফলে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
সালে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মর্যাদা পায়।