সমাজ গবেষণার তত্ত্বের কার্যাবলি আলোচনা কর।
অথবা, সমাজ গবেষণায় তত্ত্বের অবদান আলোচনা কর।
অথবা, সমাজ গবেষণায় তত্ত্বের ভূমিকা ব্যাখ্যা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : যে কোনো বিজ্ঞানের প্রধান লক্ষ্য তত্ত্বায়ন বা তত্ত্ব প্রদান। ঘটনা, প্রত্যয়, গঠন, প্রস্তাবনা, সাধারণীকরণ, আইন প্রভৃতি আলাদাভাবে আলোচিত হলেও এদের তত্ত্বের মধ্যে। অন্যভাবে বলা চলে, আমরা ব্যক্তব্যভঙ্গি, বচনরীতি, যুক্তির বিন্যাস, পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্তসমূহ দিয়ে একটি সুসংবদ্ধ কাঠামো প্রদানের চেষ্টা করি। সে কারণেই বলা হয়ে থাকে প্রত্যয় থেকে পর্যবেক্ষণ পর্যন্ত পরিভ্রমণ আমাদেরকে এমন একটি উদ্দেশ্যের দিকে চালিত করে, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো নিষ্কর্ষণ বা বিমূর্তায়ন বা অমূর্তায়ন । আমরা তত্ত্বের মধ্যদিয়ে এ সাধারণীকৃত বিমূর্ত অথচ সরল রূপকে পেয়ে থাকি। তত্ত্বের উপাদানসমূহকে বিশ্লেষণের খাতিরে আলাদা করা গেলেও তাদের সুসংবদ্ধ অবস্থানটি আমাদেরকে একটি সুশৃঙ্খল ধারণা দেয়। বস্তুত ধারণাকে প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ভাষার যৌক্তিক ও সুসামঞ্জস্য ব্যবহার তত্ত্বের প্রধান অবলম্বন । তত্ত্বকে মূলত ভাষাশ্রয়ী আন্তঃপ্রত্যয় সম্পর্ক সমৃদ্ধ এক বিশেষ প্রতীক বুনন বলা হয়।
তত্ত্বের কার্যাবলি ও ভূমিকা : তত্ত্বের ভূমিকা ও কার্যাবলি সম্পর্কে বিভিন্ন তাত্ত্বিক বিভিন্ন মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। Goode and Hatt (1952) মনে করেন, “তত্ত্ব কতকগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় তত্ত্ব একটি প্রধান কৌশল হিসেবে এ ভূমিকা রাখে ।” তত্ত্বের এ ভূমিকাকে নিম্নোক্ত উপায়ে শ্রেণিবদ্ধ করেন। যথা :
ক. একটি বিজ্ঞানের প্রধান অভিমুখীনতাকে তত্ত্বই সংজ্ঞায়িত করতে সক্ষম হয়। কারণ তত্ত্বই নির্ধারণ করে উক্ত বিজ্ঞানে কি ধরনের উপাত্তের প্রয়োজন।
খ. তত্ত্বই একটি প্রত্যয়গত কাঠামো প্রদান করে। এর ভিত্তিতেই প্রাসঙ্গিক বিষয়কে নিয়মায়িত, শ্রেণিবন্ধ ও পরস্পর সম্পর্কিত করা হয়।
গ. তত্ত্ব ঘটনাসমূহের অভিজ্ঞতাভিত্তিক সাধারণীকরণের ব্যবস্থা করে দেয়; পর্যবেক্ষণসমূহ সাধারণ রূপ পরিগ্রহ করে সংক্ষিপ্ত ঘটনাকে ব্যক্ত করে।
ঘ. তত্ত্ব ভবিষ্যৎ ঘটনাকে ব্যক্ত করে।
ঙ. তত্ত্ব আমাদের জ্ঞানের ফাঁককে চিহ্নিত করে।
সে যাহোক, তত্ত্ব গবেষণার বিকাশ, পরিচালনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নিমে তত্ত্বের এ ধারাবাহিক কার্যাবলি আলোচনার করা হলো :
তত্ত্ব অনুসন্ধানের দিক নির্দেশনা দেয় : একটি তত্ত্বগবেষক বা বিজ্ঞানীর অনুসন্ধানের দিকনির্দেশনা দেয়। অর্থাৎ প্রতিটি পর্যবেক্ষণের পিছনেই একটি তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ বা কাঠামো কাজ করে। গবেষক কোন ধরনের ঘটনা বা তথ্য পর্যবেক্ষণ ও লিপিবদ্ধ করবেন তা নির্ধারিত হয় তত্ত্বের আলোকে। একটি তত্ত্বের প্রধান কাজ হলো এ যে, এটি পর্যবেক্ষণীয় বা অনুসন্ধানযোগ্য তথ্যের সংখ্যাকে সীমিত করে। পৃথিবীর যে কোনো ঘটনা বা বস্তুকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অনুসন্ধান করা চলে। যেমন- একটি ফুটবলকে এর আর্থিক মূল্য, সামাজিক মূল্য, চত্তবিনোদনমূলক মূল্য ইত্যাদি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা চলে। ঠিক তেমনিভাবে ফুটবলের রাসায়নিক বিশ্লেষণও হতে পারে। কারণ এটি রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে শ্রেণিবিন্যাস এবং ধারণাগত কাঠামো নির্মাণে তত্ত্ব : তত্ত্ব ঘটনাবলির শ্রেণিবিন্যাস এবং ধারণা গঠনে সাহায্য করে। বস্তুত জ্ঞানকে সুসবংবদ্ধ করতে হলে একটি পদ্ধতির প্রয়োজন হয়, যার সাহায্যে তথ্যসমূহকে শ্রেণিবিন্যস্ত ও সংক্ষিপ্ত করা চলে। তাই বিজ্ঞানীরা তাত্ত্বিক কাঠামো ব্যবহার করেন। সেজন্য বিজ্ঞানের একটি প্রধান কাজ হলো শ্রেণিবিন্যাসের জন্য একটি পদ্ধতি বা কতকগুলো ধারণার একটি কাঠামো তৈরিকরণ এবং এসব ধারণার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ। মনোবিজ্ঞানে এবং সমাজবিজ্ঞানে বহু ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। বিজ্ঞানীরা কোন ধরনের ঘটনা বা তথ্য পর্যবেক্ষণ করবেন তা এ ধারণাগুলোর সাহায্যে নির্ধারিত হয়। বিজ্ঞানী যদিও অনেক সময় কতকগুলো তথ্যের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেন, তবু তার বেশিরভাগ কাজই হলো বহুসংখ্যক তথ্য সংগহ করে সেগুলোকে সাধারণীকরণ করেন। সমাজবিজ্ঞানীগণ ও মনোবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিশু পালন পদ্ধতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং শিশু পালন পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন জাতীগোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য দেখান, জনসংখ্যা বিশারদ একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জন্ম, মৃত্যু সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করে স্থুল জন্মহার এবং
মৃত্যুহার নির্ণয় করেন। এগুলো হলো তথ্যের সংক্ষিপ্তকরণ প্রক্রিয়ার উদাহরণ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বহুসংখ্যক বর্ণনাকে ব্যাখ্যা করতে হলে তত্ত্বের প্রয়োজন। তথ্যকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে তার কোন অর্থ হয় না। সেজন্য তথ্যকে ব্যাখ্যা করতে হলে তত্ত্বের সাথে মিলিয়ে দেখতে হয়। যেমন- মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের আবাসিক এলাকার চেয়ে বস্তি এলাকায় অপরাধের ঘটনা অপেক্ষাকৃত বেশি। এ বাক্যটিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, এখানে বেশ কতকগুলো জটিল পর্যবেক্ষণ এবং সেগুলোর উপরে ভিত্তি করে গঠিত কতকগুলো সাধারণ
ধারণার মধ্যে সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। এ ধরনের কতকগুলো ধারণার সম্পর্কের মধ্যে একটি তথ্য যেমন অপরাধ এর ঘটনা অর্থপূর্ণ হয়।
তত্ত্ব তথ্য সম্পর্কে পূর্বানুমানে সাহায্য করে : তত্ত্বের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এ যে, তত্ত্বের সাহায্যে ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারা যায়। আমরা যদি জানি যে, শাস্তি প্রদান আগ্রাসী আচরণের জন্ম দেয়, তাহলে কোন পরিবারে এসব পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকলে আমরা সে পরিবারের সন্তানদের মধ্যে আগ্রাসী আচরণ ঘটবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি । ঠিক তেমনিভাবে আমরা যদি লক্ষ করি যে, আমেরিকার কোন শহরের একটি বস্তিতে সংঘটিত হার উক্ত শহরের মধ্যবর্তী অংশের হারের চেয়ে কম অথবা ২৫-৩৪ বছরের বয়স্ক বিপত্নিক লোকদের পুনর্বিবাহের হার ঐ বয়সের অবিবাহিতদের বিবাহের হারের চেয়ে কম, তাহলে আমরা আশ্চর্য হব। কারণ এসব ঘটনা সম্পর্কে ইতোপূর্বে আমরা বহুসংখ্যক তথ্য সংগ্রহ করেছি এবং এগুলো সম্পর্কে সাধারণ ধারণায় উপনীত হয়েছি। সুতরাং, যেসব অঞ্চল থেকে আমরা তথ্য সংগ্রহ করিনি, সেসব অঞ্চলে একই ধরনের ঘটনা প্রত্যাশা করতে পারি। আমরা আশা করি যে অন্য যে
কোনো অঞ্চল থেকে ভবিষ্যতে তথ্য সংগ্রহ করা হলেও একই ধরনের আচরণের নমুনা পাওয়া যাবে। এর কারণ হলো :
১. আমরা জানি এ ধরনের আচরণের শর্তগুলো কি এবং
২. আমরা বিশ্বাস করি যে, এ ধরনের শর্ত নতুন পরিস্থিতিতে বা অন্য স্থানেও পাওয়া যাবে ।
উল্লিখিত দুটি বাক্য সাধারণভাবে একথাই ব্যক্ত করে যে, আমাদের পূর্বানুমানের পিছনে তত্ত্বের সমর্থন থাকে। যে কোনো একটি তত্ত্বে বলা হয় যে, কতকগুলো নির্দিষ্ট শর্ত উপস্থিত থাকলে কতকগুলো নির্দিষ্ট ধরনের ঘটনা বা আচরণ ঘটবে । তাছাড়া তত্ত্বে কতকগুলো পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া এবং গাণিতিক কৌশলের নির্দেশনা থাকে এবং এগুলোর প্রয়োগ কোন ধরনের ফলাফল পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে পূর্বাভাস করাও পদ্ধতি নির্দেশ করা হয়। অর্থাৎ, একটি তত্ত্বে কোন ধরনের তথ্য প্রত্যাশা করতে হবে সে সম্পর্কে পূর্বাভাস দিয়ে থাকে । সুতরাং, তত্ত্ব গবেষককে কতকগুলো দিকনির্দেশ দেয় যার মাধ্যমে গবেষক বুঝতে পারেন তিনি কি ধরনের তথ্য পর্যবেক্ষণ করতে সমর্থ হবেন।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সমাজ গবেষণায় তত্ত্ব তথ্যের সাধারণীকরণ ও পূর্বানুমান সাহায্যের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তত্ত্বের মাধ্যমেই গবেষণা সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা হয় এবং গবেষণা কর্মটির শেষে একটি তাত্ত্বিক কাঠামো বিনির্মাণ করা হয়।