বাংলাদেশে সংশোধনমূলক কার্যাবলিসমূহ লিখ।

অথবা, বাংলাদেশে সংশোধনমূলক কার্যাবলিসমূহ বিশ্লেষণ কর।
অথবা, বাংলাদেশে সংশোধনমূলক কার্যাবলিসমূহ ব্যাখ্যা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা :
কোনো দোষী অপরাধীকে শাস্তি না দিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞান ভিত্তিক কৌশল প্রয়োগ করে তার চরিত্র সংশোধনের জন্য যেসব কার্যাবলি পরিচালনা করা হয় তাকে সংশোধনমূলক কার্যাবলি বলে। অন্যভাবে বলা যায় যে সব ব্যবস্থা ও কার্যাবলির মাধ্যমে অপরাধীর আচরণ ও চরিত্র সংশোধনের প্রচেষ্টা চালানো হয় সেগুলোর সমষ্টিকেই সংশোধনমূলক কার্যাবলি বলা যায়। এটি একটি পেশাদার সেবাকর্ম যে ক্ষেত্রে অপরাধীর অপরাধমূলক আচরণ নিরাময় ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশের সংশোধনমূলক কার্যক্রমসমূহ : বাংলাদেশে যে সমস্ত সংশোধনমূলক কার্যক্রম পরিচালিত হয় সেগুলো হলো :
১. প্রবেশন,
২. প্যারোল,
৩. মুক্ত কয়েদি পুনর্বাসন
৪. আটক নিবাস বা রিমান্ড হোম,
৫. বোরস্টাল স্কুল,
৬. কিশোর আদালত,
৭. ট্রেনিং স্কুল ও
৮. আফটার কেয়ার সার্ভিস ইত্যাদি।
১. প্রবেশন : প্রবেশন হলো এমন একটি মর্যাদা যে প্রক্রিয়ায় কারারুদ্ধ করার প্রক্রিয়া শর্তপূরণ সাপেক্ষে প্রত্যাহার করা হয়। সাধারণত এ ধরনের শর্তের অন্তর্ভুক্ত হলো প্রবেশন অফিসারের (যিনি সমাজকর্মীও হতে পারে) মাধ্যমে নিয়মিত আদালতে হাজির হওয়া। প্রবেশনের শর্তগুলো হলো :
i. ভবিষ্যতে অপরাধ না করার অঙ্গীকার।
ii. আদালতের অনুমতি ছাড়া পেশা ও বাসস্থান পরিবর্তন না করা।
iii. আদালতে নিয়মিত নির্দিষ্ট তারিখে হাজির হওয়া,
vi. প্রবেশন অফিসারের সাথে নিয়মিত সাক্ষাৎ করা।
v. সকলের সাথে সদাচরণ করা।
vi. প্রবেশন অফিসারের নির্দেশাবলি মেনে চলা।
vii. আদালত কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশমালা মেনে চলা।
প্রবেশন ব্যবস্থা এবং প্রবেশন কার্যক্রমকে যথাযথভাবে কার্যকর এবং অর্থবহ করতে হলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিস্তারিতভাবে অনুসন্ধান ও চিন্তাভাবনা করতে এবং তারই আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রবেশন ব্যবস্থার কতকগুলো কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হয়।
আদালত কর্তৃক নির্ধারিত প্রবেশন কর্মকর্তার মূল দায়িত্ব হচ্ছে প্রবেশনাধীন অপরাধীকে তার চারিত্রিক সংশোধন আনয়নে এবং সামাজিক পুনর্বাসনে সাহায্য করা। এ প্রসঙ্গে Devid Dressler তার Practice and theory of probation and parole নামক গ্রন্থে প্রবেশন কর্মকর্তার কর্ম কৌশলগুলোকে চার ভাগে বিভক্ত করেছেন।এগুলো হলো :
i. বস্তুগত সাহায্য কৌশল (Material aid Techniques);
ii. প্রশাসনিক কৌশল (Executive Techniques);
iii. তত্ত্বাবধায়ক কৌশল (Guidance Techniques);
iv. পরামর্শদান কৌশল (Counselling Techniques).
সারা বাংলাদেশই প্রবেশন কার্যক্রমের আওতাভুক্ত। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়াধীন সমাজসেবা অফিসারের মাধ্যমে দেশের ২২টি বৃহত্তর জেলায় এবং ৩টি সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে একজন করে প্রবেশন অফিসার কার্যরত আছে। এছাড়া ৪২টি নতুন জেলা সদরে কর্মরত ৪২ জন কর্মসেবা অফিসার, ৪০০টি উপজেলায় কর্মরত ৪০০ জন উপজেলা সমাজসেবা অফিসার এবং ১৫টি শহর এলাকায় কর্মরত শহর সমাজসেবা অফিসারকে তাদের নিজ দায়িত্বে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রবেশন অফিসারের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
২. প্যারোল : প্যারোল মূলত একটি সংশোধনমূলক কার্যক্রম। প্রবেশনের মতোই প্যারোল ব্যবস্থাতেও অপরাধীদের মুক্তি দিয়ে সংশোধনের সুযোগ করে দেয়া হয় ।প্যারোল অপরাধ সংশোধনের এমন একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত ব্যক্তি কিছু দিন দণ্ড ভোগের পর কতিপয় শর্তসাপেক্ষে প্যারোল অফিসারের তত্ত্বাধানে সাময়িকভাবে মুক্তিপ্রাপ্ত হন।অন্যভাবে বলা যায়, বিচারে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি কিছুদিন সাজাভোগের পর তার সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই বিশেষ শর্তাধীনে মুক্তিদানের ব্যবস্থাকে প্যারোল বলা হয়।
প্যারোলের শর্ত : প্যারোলে কতিপয় শর্ত প্রদান করা হয়।এগুলো হলো :
i. ভবিষ্যতে অপরাধ না করার অঙ্গীকার করা,
ii. প্যারোল কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বাসা, পেশা ও ঠিকানা পরিবর্তন না করা।
iii. নিয়মিত ও নির্দিষ্ট সময়ে প্যারোল অফিসারের সাথে সাক্ষাৎ করা।
iv. প্যারোল অফিসারের উপদেশমতো চলা।
v. সকলের সাথে সদাচরণ করা।
vi. শর্ত ভঙ্গ করলে পুনরায় জেলহাজতে থাকার অঙ্গীকার করা।
vii. সুবিধাজনক সময়ে প্যারোলে থাকা ব্যক্তির বাসা তল্লাশির অনুমতি দান।
viii. বিতর্কিত যে কোনো কাজ না করা।
ix. প্রয়োজন হলে স্বেচ্ছামূলক কাজে অংশগ্রহণ করা।
বাংলাদেশে প্যারোল ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। আমাদের দেশে সাধারণত স্বনামধন্য ব্যক্তিরা এ সুবিধা পেয়ে থাকে।সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ দীর্ঘদিন প্যারোলে মুক্তি লাভ করেছিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, আমলা ও খ্যাতিমান ব্যক্তিরাই মূলত প্যারোলে মুক্তি পান।
৩. মুক্ত কয়েদি পুনর্বাসন : সংশোধনমূলক কার্যাবলির মধ্যে একটি অন্যতম কার্যাবলি হলো ‘মুক্তি কয়েদি পুনর্বাসন’। মুক্ত কয়েদি পুনর্বাসন বলতে এমন একটি কর্মসূচিকে বুঝানো হয় যেক্ষেত্রে জেল খাটার পর কয়েদিদের সমাজে অন্যান্য মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপনে আর্থসামাজিকভাবে সহায়তা প্রদান করা হয়। মুক্ত কয়েদিদের অনেকক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন :
*পূর্বের অপরাধের কারণে সমাজ তাকে ভাল চোখে দেখে না।
*তাদের পরিবারের সাথে সাধারণত অন্য পরিবারের ছেলেমেয়েদের বিবাহ দিতে চায় না।
*দীর্ঘদিন কারাভোগের কারণে পারিবারিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় ।
*তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও শোচনীয় হয়ে পড়তে পারে।
*সমাজ তাদের স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ না করায় সামঞ্জস্য বিধানে অক্ষমতার কারণে তারা পুনরায় অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠতে পারে।
*উল্লেখিত কারণে মুক্তি প্রাপ্ত কয়েদিদের সমাজে স্বাভাবিকভাবে পুনর্বাসন বাধাগ্রস্ত হয়। এ বাধাকে অপসারণ করা ও নিম্নোক্ত লক্ষ্যকে সামনে রেখে মুক্ত কয়েদিদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়। যেমন :
*অপরাধীকে সামঞ্জস্য বিধানে সহায়তা করা।
*আর্থসামাজিকভাবে সমাজে পুনর্বাসিত করা।
*পুনরায় অপরাধ প্রবণ যাতে না হতে পারে তার ব্যবস্থা করা।
*স্বাভাবিক ও সুস্থভাবে সমাজে বসবাস করতে সহায়তা করা।
*তাদেরকে স্বাভাবিক পারিবারিক জীবনের নিশ্চয়তা বিধান করা।
৪. আটক নিবাস বা রিমান্ড হোম : অভিযুক্ত কিশোর বা কিশোরীদের বিচারকার্যের পূর্বে তাদেরকে সাময়িকভাবে যেখানে আটক রাখা হয় তাকে আটক নিবাস বা Remand home বলে। আটক নিবাসে রাখার মাধ্যমে অভিযুক্তদের অপরাধ সংক্রান্ত বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আটক নিবাসে নিম্নোক্ত ধরনের কিশোর কিশোরীদের আটক রাখা হয় :
১. অবহেলিত ও বঞ্চিত পলাতক অথবা হারিয়ে যাওয়া কিশোর কিশোরী।
২. আদালতে সাক্ষ্যদানের নিমিত্তে কোন প্রতিষ্ঠান, পরিবার বা অন্য কোনো স্থান থেকে পলাতক কিশোর কিশোরী।
৩. অভিযুক্ত কিশোর কিশোরী।
৪. সংশোধনের নিমিত্তে আদালতের আদেশ অনুযায়ী কোনো সংশোধনমূলক প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হবে এমন কিশোর কিশোরী।
বাংলাদেশে কিশোর অপরাধে কোনো মামলা দায়েরের পর মামলা নিযুক্তির মধ্যবর্তী সময়ে কোনো কিশোর বা কিশোরীকে আটক নিবাসে রাখার বিধান রয়েছে। আটক নিবাসে থাকাকালীন সময়ে কোনো তদন্তকারী কর্মকর্তা Social case worker অথবা প্রবেশন অফিসারের মাধ্যমে তাদের অপরাধ সম্পর্কিত প্রকৃত তথ্য উদ্ঘাটন করা হয় এবং তথ্য আদালতে পেশ কর া হয়। আটক নিবাস মূলত অপরাধে অভিযুক্ত কিশোর কিশোরীদের সাময়িক আশ্রয় কেন্দ্র। এ কেন্দ্রে তাদের খেলাধুলা, রক্ষণাবেক্ষণ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।
৫. বোরস্টাল স্কুল (Borstal school) : শিশু কিশোরদের আচার-আচরণ ও চরিত্র সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান হলো বোরস্টাল স্কুল (Borstal school)। সাধারণত ১৫-২০ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের আচরণ সংশোধনকল্পে বোরস্টাল স্কুল স্থাপন করা হয়। বোরস্টাল স্কুলে আচরণ সংশোধনের জন্য নিম্নোক্ত কার্যাবলি পরিচালিত হয় :
১. শিশুদের সাধারণ ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদান;
২. ধর্মীয় ও নৈতিক বিষয়ে শিক্ষা দান;
৩. মনঃচিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা;
৪. প্রয়োজনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা;
৫. ব্যক্তি সমাজকর্ম ও দল সমাজকর্ম পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে সংশোধনের চেষ্টা।
৬. কিশোর আদালত : কিশোররাই একটি জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার। তাদের হাত ধরেই জাতি ছিনিয়ে আনবে ভবিষ্যৎ সোনালী ঠিকানা। কিন্তু তারা যদি অপরাধ প্রবণ হয়ে অঙ্কুরেই তাদের জীবনকে ধ্বংস করে দেয়, তাহলে জাতীয় অগ্রগতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। আর তাই এ কিশোর অপরাধীদের সংশোধনের মাধ্যমে সমাজে পুনর্বাসিত করতে ভিন্ন ধাঁচের আদালত ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। কিশোর অপরাধের বিচারের জন্য প্রতিষ্ঠিত এ আদালতের নামই কিশোর
আদালত।সমাজ থেকে কিশোর অপরাধ নির্মূল করতে এ কিশোর আদালতের গুরুত্ব অপরিসীম।
৭. ট্রেনিং স্কুল : শিশু কিশোরদের অপরাধমূলক বা ত্রুটিপূর্ণ আচরণ সংশোধনের লক্ষ্যে তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য যে স্কুল স্থাপন করা হয় তাকে ট্রেইনিং স্কুল বলে। একে Reform school বলেও অভিহিত করা হয়।সাধারণত ১৭- ২০ বছর বয়সী অপরাধ প্রবণ শিশুদের জন্য এই স্কুল স্থাপন করা হয়।
৮. আফটার কেয়ার সার্ভিস : এ কার্যক্রমের মাধ্যমে জেল ফেরত কয়েদিদের সমাজে একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ও উপার্জনক্ষম নাগরিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে সাধারণ শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা ও বিভিন্ন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, সংশোধনমূলক কার্যাবলির মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের সহায়তা করা হয়ে থাকে। তাই এগুলো জানা সমাজকর্মীর জন্য অত্যাবশ্যক।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%a4%e0%a7%83%e0%a6%a4%e0%a7%80%e0%a6%af%e0%a6%bc-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%af%e0%a6%bc%e0%a6%ac%e0%a6%bf%e0%a6%ad%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a8-%e0%a6%95/