অথবা, তত্ত্বের সংজ্ঞা উল্লেখপূর্বক তত্ত্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ বিশ্লেষণ কর।
অথবা তত্ত্বের সংজ্ঞার আলোকে এর বৈশিষ্ট্যসমূহের বর্ণনা দাও।
উত্তরা ভূমিকা : সামাজিক গবেষণায় তত্ত্ব একটি মৌল প্রত্যয়। তত্ত্ব সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রকে ত্বরান্বিত উঠে।
করে থাকে। সমাজে যেসব ঘটনা ঘটে থাকে তা প্রত্যেকটি এক বা একাধিক তত্ত্বের উপর নির্ভর করে গড়ে বিজ্ঞানের অস্তিত্ব যেমন তার অনুসৃত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপর নির্ভর করে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাফল্যও তেমনি তার উদ্ভাবিত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উপর নির্ভরশীল। সেজন্য তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির কেবল একটি মৌলিক ধারণাই নয়, বরঞ্চ তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির চালিকাশক্তি এবং উদ্দেশ্যও বটে।
তত্ত্ব : সাধারণভাবে তত্ত্বকে অবাস্তব ও কল্পনাধর্মী বলে মনে করা হয়। বৈজ্ঞানিক যুগের প্রারম্ভে তত্ত্ব প্রায়ই কল্পনাশ্রয়ী ছিল। বিজ্ঞানের বিকাশের সাথে সাথে তত্ত্ব ও তথ্যের মধ্যে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে এবং অধিক তথ্য নির্ভর হয়েছে। তত্ত্ব সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে- Theory is a set of interrelated proposition some of which can be empirically tested. অর্থাৎ তত্ত্ব হচ্ছে কতকগুলো প্রস্তাবনার সমষ্টি যেগুলো বাস্তবতার নিরিখে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা যায়।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : তত্ত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত ও ধারণা প্রচলিত আছে । ধ্রুপদী সমাজবিজ্ঞানীদের (Classical Sociologists) দৃষ্টিতে (মার্কস, ওয়েবার, ডুরখেইম প্রমুখ) “Theory is a set of untestable statements.” অর্থাৎ, তত্ত্ব হলো অপরীক্ষাযোগ্য বিবৃতির সমষ্টি। বর্তমান কালের সমাজ গবেষকগণ (যেমন- উইলিয়াম জে. গুড, পল. কে. হেট প্রমুখ) মনে করেন যে, নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর জড়োকৃত ঘটনার সমষ্টি হলো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব।
সমাজবিজ্ঞানী টার্নার (Turmer) তত্ত্বের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “কোনো সত্য নীতি বা কোনোকিছু ঘটনার সাধারণীকরণের লক্ষ্যে সাধারণত তত্ত্ব গঠিত হয়।”
ল্যুভবার্গ (Lundberg) এর মতে, “তত্ত্ব হলো সাধারণ পর্যবেক্ষণযোগ্য কোনো একটি প্রক্রিয়া ।” আবার গুড এবং হেট (Goode and Hatt) এর ধারণায়, “সামাজিক গবেষণার ক্ষেত্রে তত্ত্ব একটি অনুসন্ধানমূলক কার্যক্রম ।”
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায়, তথ্য হলো কতগুলো প্রস্তাবনার সমষ্টি যা বাস্তবতার আলোকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা যায়। তত্ত্বের বৈশিষ্ট্যসমূহ : সমাজ গবেষকগণ তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অনেক আলোচনা করেছেন। এছাড়া তত্ত্বের সংজ্ঞার দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, এর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিম্নে এগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো :
১. তত্ত্ব বাস্তবতাকে ব্যাখ্যার মানবীয় ক্ষমতা : তত্ত্ব একটি মানসিক কর্মকাণ্ড, করুণার জগৎ ও যুক্তি আশ্রয়ী মনের সৃজনশীল সংগঠন ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। এটি বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করার মানবীয় ক্ষমতা, যা শব্দ সম্পর্ক, যুক্তি, আঙ্গিক পারম্পর্য, সিদ্ধান্ত প্রভৃতির মাধ্যমে সুশৃঙ্খলভাবে উপস্থাপিত ।
২. তত্ত্বে ঘটনার নির্বিশেষ রূপকে পাওয়া যায় : তত্ত্বের মধ্যে ঘটনা বা আচরণ বা ক্রিয়ার নির্বিশেষ রূপকে পাওয়া যায়। যেমন- বঞ্চনা ও হতাশা থেকে বিদ্রোহের সূত্রপাত হতে পারে । তত্ত্ব যত বেশি বিমূর্ত প্রত্যয় ধারণ করে, তত বেশি বিমূর্ত তত্ত্বের রূপ নেয়।
৩. তত্ত্ব সামাজিক বাস্তবতার ধারণা দেয় : তত্ত্ব সামাজিক বাস্তবতার একটি বিশেষ অংশ বা দিক সম্পর্কে ধারণা দেয়। সমাজ নির্বিশেষে ব্যাপক প্রকৃতির তত্ত্বের অস্তিত্ব যে নেই তা নয়, তবে এ ধরনের তত্ত্বের পুনর্বিচার বা প্রয়োগ বড় কঠিন।
৪. তত্ত্ব চিরস্থায়ী নয় : অনুসিদ্ধান্তের মতো তত্ত্বও অস্থায়ী । পরম সত্যকে তুলে ধরার জন্য তত্ত্ব প্রদান করা হয় না। তত্ত্ব সংশোধিত হতে পারে। আমাদের জ্ঞানের উৎকর্যের মাত্রা নির্দেশক হিসেবে তত্ত্বের মূল্যায়ন হওয়া উচিত। অর্থাৎ, আমাদের তত্ত্বের গুণাগুণ নির্দেশ করবে আমরা কতটা অগ্রসর চিন্তার অধিকারী ।
৫. তত্ত্ব বিজ্ঞানের অবয়ব গঠনে সহায়তা করে : ঘটনা হলো অভিজ্ঞতার মাধ্যমে চাষাইযোগ্য পর্যবেক্ষণ । ঘটনা পর্যবেক্ষণসমূহের উপর ভিত্তি করে গঠিত। ঘটনা ও তত্ত্বের সমন্বয়েই বিজ্ঞানের অবয়ব গঠিত হয়।
৬. তত্ত্ব গবেষণাকে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে : তত্ত্ব যেমন গবেষণাকে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে, তেমন গবেষণারও- উত্তম লক্ষ্য হওয়া উচিত তত্ত্ব নির্মাণ।
৭. ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা : তাত্ত্বিক প্রক্রিয়ায় ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্তের স্বাধীন ও বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ বিদ্যমান।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, তত্ত্ব বিচিত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। গবেষণার চূড়ান্ত পরিণতি হলো তত্ত্ব। যে কোনো গবেষণার সফলতা নির্ভর করে তত্ত্বের উপর। আবার সফল গবেষণা থেকে গড়ে উঠে ভালো হয়।