বাঙালির জাতীয়তাবাদ বিকাশে ছয়দফার গুরুত্ব আলোচনা কর।

অথবা, বাঙালির জাতীয়তাবাদ বিকাশে ছয়দফার তাৎপর্য বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নামক দুটি পৃথক ভূখণ্ড নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। এ দুটি অংশের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক পার্থক্য ছিল বিস্তর। শুধু ধর্মের উপর ভিত্তি করে এ দুটি অংশকে একত্রিত করে রাষ্ট্র গঠন করা হয়। কিন্তু অচিরেই এ দুটি অংশের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে আন্দোলনে নামতে বাধ্য করে। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশ লাভ করে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ছয়দফার গুরুত্ব : পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি যে অপশাসনের সূচনা করে তার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন সময় আন্দোলন হয়েছে। পাকিস্তান সরকার কখনো সংস্কৃতিকে, কখনো ভাষাকে, কখনো বা বাঙালির অস্তিত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করেছে। ফলে বাঙালি তথা পূর্ব পাকস্তানের জনগণ বারবার বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে প্রতিবাদ করেছে নিজ অধিকার আদায়ের জন্য। এরই ধারাবাহিকতায় শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায়ের জন্য ছয়দফা কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন। ছয়দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের পর্যায় শুরু হয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের চরম বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ উচ্চারিত হয় শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা দাবি ঘোষণার মধ্য দিয়ে। শেখ মুজিবুর রহমান এ দাবিকে ‘বাঙালির বাঁচার দাবি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ দাবির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সম্পদ, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় ও বৈদেশিক আয়ের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, প্রাদেশিক নিরাপত্তার জন্য মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের প্রস্তাব করা হয়। দাবির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাবলম্বী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করা হয়। আর তাই এ ৬ দফা দাবিকে অভিহিত করা হয় ‘মুক্তির সনদ’ বলে। এ আন্দোলনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় অপশাসনের বিরুদ্ধে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান ঐক্যবদ্ধ হয় ভাষা আন্দোলন ও ছাত্রদের শিক্ষা আন্দোলনের সময় যে জাতিগত ঐক্য পরিলক্ষিত হয় তারই চূড়ান্ত রূপ প্রকাশিত হয় ছয়দফা আন্দোলনের মাধ্যমে। ছয়দফা আন্দোলন হয়ে উঠে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের আন্দোলন। এ আন্দোলনের সাংগঠনিক শক্তিও ছিল অনেক বেশি। শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের হাতে ছিল এ আন্দোলনের নেতৃত্ব। এ আন্দোলনের মুখ্য ভূমিকা পালন করে ছাত্রলীগ। ছাত্র ইউনিয়ন ও বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন। সারাদেশব্যাপী জনসভা করে এ আন্দোলন ছড়িয়ে দেয়া হয়। ছয়দফার মধ্যে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির আশা আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়। ফলে বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সরকারি কর্মকর্তা ও ছাত্রজনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ আন্দোলনে শরিক হয়। এ আন্দোলন বাংলার কৃষক, মজুর, শ্রমিক, তথা আপামর জনসাধারণের মুক্তির সনদে পরিণত হয়, যা অধিকার আদায়ের এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ সকল বাঙালির জাতীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশের জন্য এ আন্দোলন ছিল অভূতপূর্ব। সকল মানুষ মিলে মিশে একটি অখণ্ড জাতীয়তা বোধে উজ্জীবিত হয়েছিল এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ গণতন্ত্রে যেমন ‘Magna Carta’ ফরাসি বিপ্লবে যেমন ‘Bill of Right’ আমেরিকার স্বাধীনতায় যেমন ‘Individual Freedom’, রুশ বিপ্লবে যেমন ‘Classless society’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যও ছিল তেমনি ‘ছয়দফা’ কর্মসূচি। ছয়দফার মাধ্যমেই বাঙালি জাতি একত্রিত হয়েছিল অখণ্ড স্বার্থ রক্ষার জন্য। আগরতলা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে যে প্রবল গণআন্দোলনের সূচিত
হয়, ঊনসত্তরের যে গণঅভ্যুত্থান তাতে বাঙালি জাতির একটি অখণ্ড চেতনা স্পষ্ট হয়ে উঠে। আর এ অখণ্ড চেতনাই বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, ৬ দফা কর্মসূচিকে ঘিরে যে, জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে তা পূর্ব পাকিস্তানে বহুবার স্পষ্ট হয়েছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত বিভিন্ন আন্দোলনে। তবে তাতে আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণ ছিল না। কিন্তু ছয়দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে জাতীয়তাবাদের উদ্ভব তা ছিল অভূতপূর্ব। তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ছয়দফা আন্দোলনের গুরুত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই।