অথবা, ছয়দফা আন্দোলন মধ্যবিত্ত শ্রেণির আন্দোলন, বিশ্লেষণ কর।
অথবা, ১৯৬৬ সালে ছয়দফা কর্মসূচিকে বাঙালি কেন সমর্থন করেছিল?
উত্তর৷ ভূমিকা : ছয়দফা ছিল মূলত পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা সম্পর্কিত দাবি। শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। প্রত্যেক শ্রেণি তার দিকে তাকায় যাতে তার স্বার্থ উদ্ধার হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের চরিত্রগত বিশ্লেষণে তারা ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির। সুতরাং এরা যেমন দাবিদাওয়া
উত্থাপন করেছিলেন তা নিঃসন্দেহে তাদের স্বার্থের জন্য।
ছয়দফা কর্মসূচি মধ্যবিত্ত শ্রেণির আন্দোলন কি না : এ বিষয় সম্বন্ধে জানার পূর্বে আমাদেরকে শ্রেণি সম্বন্ধে জানতে হবে কোন শ্রেণির দ্বারা দাবি উত্থাপন হয়েছিল তা আলোচনা করা প্রয়োজন।
শ্রেণি : Marx এর মতে, শ্রেণি হলো ব্যক্তি সমষ্টি, যারা উৎপাদনের ব্যবহার, একই রকম কার্য করে ও অন্যান্য গ্রুপের সাথে সংঘাতময় চাপের মুখে পিষ্ট হয়। স্বতন্ত্র্য ব্যক্তিরা এক একটি শ্রেণি তখনই গঠন করে। যখন তাদের একটি শ্রেণির বিরুদ্ধে সাধারণত সংগ্রাম চালাতে হয়। একটি শ্রেণি এভাবে ব্যক্তিসত্তার ঊর্ধ্বে উঠে স্বতন্ত্র সত্তার অধিকারী হয়। আর ব্যক্তির অধিকার, তার জীবনের সব সুযোগ সুবিধা ও ব্যক্তিগত উন্নতি তার শ্রেণি দ্বারা নির্ধারিত হয়। অধ্যাপক ম্যাকাইভার ও পেজ তাঁদের ‘Society’ নামক গ্রন্থে বলেছেন যে, “শ্রেণি বলতে সমাজের এমন একটি বিশেষ অংশকে বুঝায় যে অংশ সমাজের অবশিষ্ট অংশ থেকে স্বতন্ত্র।” ম্যাক্স ও অ্যাঙ্গলেসের মতে, প্রধানত দুটি শ্রেণি :
যথা:
১. Bourgeois শিল্পপতি
২. Proletariat সর্বহারা
তার তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় তিনটি শ্রেণি লক্ষণীয় । যথা :
১. উচ্চবিত্ত শ্রেণি
২. মধ্যবিত্ত শ্রেণি
৩. নিম্নবিত্ত শ্রেণি
এরা সমাজব্যবস্থায় পিরামিডের মতো বিস্তৃত। পিরামিডের ভূমিতে রয়েছে নিম্নশ্রেণি তার উপরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং শীর্ষে রয়েছে উচ্চবিত্ত শ্রেণি। উপর্যুক্ত শ্রেণি বিশ্লেষণের প্রেক্ষাপটে আমরা বলতে পারি যে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ২২টি পরিবার ছিল উচ্চবিত্র শ্রেণি। এছাড়া প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, উচ্চশিক্ষিত সরকারি আমলা, ডাক্তার, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, স্কুল, কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ট্রেড ইউনিয়নের নেতা, ভূ-স্বামী, ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক প্রভৃতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির আওতাভুক্ত। এরা হলো পেটি বুর্জোয়া। আর যারা জীবিকানির্বাহের জন্য মোটামুটি কষ্টসাধ্য করে থাকে তাদেরকে নিম্নশ্রেণি বলা হয় ।
ছয়দফার প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ : ছয়দফা আন্দোলন কর্মসূচি মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছিল কি না তা নিচে ছয়দফা দাবিভিত্তিক আলোচনা করা হলো :
১. রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস : আওয়ামী লীগের ছয়দফা যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আন্দোলন ছিল ছয়দফা বিশ্লেষণে তা স্পষ্টভাবে বুঝা যাবে। যেমন- প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় যে দাবি তোলা হয় তা মূলত রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের কথা, যাতে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণি মর্যাদা সহকারে বাঁচতে পারে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল।
২. মুদ্রা ও অর্থসংক্রান্ত দাবি : মুদ্রা ও অর্থসংক্রান্ত যে দফা ছিল সেটা মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থ সম্পর্কিত। কেননা মুদ্রা পাচার বন্ধ হলে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির আর্থিক উন্নতি হবে। বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত যে দফা ছিল তাতে পূর্ব বাংলার ক্ষুদ্র শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী শ্রেণির লাভের দিকেই লক্ষ্য করে করা হয়।
৩. প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠন : ছয়দফার শেষ দফায় যে আঞ্চলি
ক প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠনের যে দাবি করা হয় তাতেও মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থের দাবি। কেননা তৎকালীন সময়ে পূর্ব বাংলার; মধ্যবিত্ত শ্রেণি, সামরিকবাহিনী, আধা- সামরিকবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে ছিল না বললেই চলে। সুতরাং সামরিকবাহিনীতে অধিকসংখ্যক লোক নিয়োগ করে পূর্ব বাংলাকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং এ দেশীয় এলিটদের রক্ষা করা।
৪. ব্যাংক, বিমা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের কোন ইঙ্গিত ছিল না : তাছাড়া ছয়দফা দাবির কোন দাবিতেই ব্যাংক, বিমা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের কোন ইঙ্গিত ছিল না। এর কারণ ব্যাংক, বিমা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন। ছয়দফা কর্মসূচিতে সমাজতন্ত্রের কোন কথাই বলা হয়নি। সাধারণ কৃষক, কুলি, মজুর শ্রমিকদের জন্য উন্নয়নের জন্য কোন শর্ত ছয়দফায় ছিল না।
উপসংহার : উপর্যুক্ত ব্যাখ্যা থেকে বুঝা যায়, ছয়দফা ছিল মূলত পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা সম্পর্কিত দাবি। শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির অন্তর্গত। প্রত্যেক শ্রেণি তার স্বার্থের দিকে তাকায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের চরিত্রগত বিশ্লেষণে তারা ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণির। সুতরাং এর যেসব দাবিদাওয়া উত্থাপন করেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে তাদের শ্রেণির স্বার্থের জন্য।