অথবা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ কর।
অথবা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ কিভাবে গড়ে উঠে?
উত্তর৷৷ ভূমিকা : ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তান আবার পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানে বিভক্ত ছিল। কিন্তু নতুন রাষ্ট্র পেলেও পূর্ব বাংলার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়। পাকিস্তানে অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক কাঠামোতে পূর্ব বাংলা কেবল অর্থনৈতিকভাবে শোষিত হয়নি, বাঙালির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অধিকারও হরণ করা হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলার অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ : যখন কোন জনসমষ্টি ভাষা, কৃষ্টি, সভ্যতা, সাহিত্য, ধর্ম প্রভৃতির আলোকে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং নিজেদেরকে অন্য জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক ভাবে তখন এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হয়। জাতীয়তাবোধ থেকেই জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি। জাতীয়তাবাদ মানুষের রাজনৈতিক চেতানায় উদ্বুদ্ধ করে তোলে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও স্বাধিকার আন্দোলন কিভাবে গড়ে উঠে নিচে তা আলোচনা করা হলো :
পূর্ব বাংলার ৫৬ ভাগ মানুষের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে মাত্র ৭ ভাগ মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র করা হলে বাঙালি জনগণ তা রুখতে সকল ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী মিলে যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে। এর মাধ্যমে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে।
এ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন “আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলি ঘরোয়াভাবে, তাই আমরা বাঙালি।”
২. ১৯৫৪ সালের নির্বাচন : মুসলিম লীগের রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং পূর্ব বাংলার প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হয়। মূলত ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ সাধিত হয়।
৩. ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন : ১৯৬২ সালে শরীফ কমিশন রিপোর্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করাসহ কতিপয় কালাকানুন সংযোজিত হয়। ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে তা প্রতিহত করে যা জাতীয়তাবাদী চেতনা দৃঢ় করে।
৪. ১৯৬৬ এর ছয়দফা : স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ছয়দফা দাবি ঘোষণা করে বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করতে শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দাবির জন্য কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। যা বাঙালি জাতীয় স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। এটি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার মুক্তির সনদ নামে আখ্যায়িত।
৫. আগরতলা মামলা : পাকিস্তানি শাসক আইয়ুব খান ছয়দফা আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নবাদী দাবি করে আখ্যায়িত করেন। তিনি শেখ মুজিবকে দমানোর জন্য রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করেন যা কি না বিখ্যাত “আগরতলা মামলা” নামে পরিচিত। এ মামলায় শেখ মুজিবকে জড়িয়ে গ্রেফতার করা হলে পূর্ব বাংলার জনগণ তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে তার প্রতিবাদ জানায় যার মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা গড়ে উঠে।
৬. ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান : আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় মুজিবসহ ৩৫ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলা প্রত্যাহার করার জন্য মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণ পাকিস্তান সরকারের গুলি, নির্যাতন, গ্রেফতার উপেক্ষা করে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে।
৭. ১৯৭০ সালের নির্বাচন : এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন পায় এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন পায়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের স্লোগান ছিল “সোনার বাংলা শ্মশান কেন।” মূলত আওয়ামী লীগের বিজয় ছিল সত্যিকার অর্থে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয়। এর মাধ্যমে বাঙালি
জাতীয়তাবাদ স্পষ্ট হয়ে উঠে।
৮.
শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য : পশ্চিম পাকিস্তানে শাসক চক্র বরাবরই পূর্ব বাংলার শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করতে চক্রান্ত করেছে। তাদের ভয় ছিল বাঙালিরা শিক্ষায় উন্নতি লাভ করলে পাকিস্তানের চাকরি ক্ষেত্রে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। ১৯৬৩ সালের পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যয় ছিল ২০৩ কোটি টাকা, পঁচাত্তরে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ৭৬.৫ কোটি টাকা। এ ব্যবধানের জন্য পূর্ব বাংলার জনগণ বিভিন্ন আন্দোলন করেছিল।
৯. ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা অর্জন : ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে শুধু বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য। আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী হলে, ক্ষমতা হস্তান্তর করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়, এতে পূর্ব বাংলার জনগণ সাড়া প্রদান করে। আর তাই ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধিকার আদায়ে বাঙালি জাতি নিজেদেরকে স্বাধীনতাকামী জনগোষ্ঠী রূপে পরিচিত করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পূর্ব বাংলার জনগণ ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতিতে ছিল বহু দেহের এক প্রাণ । এর ফলশ্রুতিতে আমরা উপলব্ধি করতে পারি ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান অবশেষে বাঙালি জাতির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য মহান স্বাধীনতা অর্জন।