অথবা, আইয়ুব শাসনবিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভূমিকা আলোচনা কর।
উত্তর৷ভূমিকা : পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণতন্ত্রকে হত্যা করে ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মির্জা সামরিক শাসন জারি করেন। ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করে সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে জেনারেল আইয়ুব খানকে সর্বাধিনায়ক করেন। সুযোগ বুঝে আইয়ুব খান ইস্কান্দার মির্জার হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়। শুরু করে লৌহ মানবের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। তাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ধৈর্য হারিয়ে অবশেষে আন্দোলনের পথ বেছে নেয়।
আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট : জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করার মাধ্যমে কেন্দ্র ও প্রদেশগুলোতে গণতান্ত্রিক ও সংসদীয় শাসনব্যবস্থার বিলোপসাধন করেন। তার সামরিক শাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল কেন্দ্রীকরণ। তিনি নিজের হাতে সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখেন। এমনকি প্রাদেশিক সরকারের উপরও তাঁর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন এবং দেশে সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেন। দুর্নীতি দমনের নামে দেশে অনেক জনপ্রিয় ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতার উপর উৎপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ প্রবর্তনের মাধ্যমে আইয়ুব খান নিজস্ব অনুগত বাহিনী গঠন করেন যা দেশের কোন কল্যাণসাধন করতে সক্ষম হয়নি। তার
ভূমিসংস্কার কাগজে-কলমেই থেকে যায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তাছাড়া আইয়ুব খান কর্তৃক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আকস্মিক গ্রেফতার, গণবিরোধী শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ইত্যাদি। আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ছাত্র ও রাজনীতিকদের উৎসাহ যোগায়। আইয়ুব শাসনবিরোধী আন্দোলন মূলত ছাত্রনেতৃবৃন্দ দ্বারা শুরু হয় এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে সাহায্য করে।
আইয়ুববিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভূমিকা : লৌহমানব নামে খ্যাত আইয়ুব খান তার শাসনামলেও স্থায়ী করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কঠোর কর্মসূচি হাতে নেয়। এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৬১ সালের শেষের দিকে মুজিব ও মানিক মিয়া এবং মণিসিংহ ও খোকা রায়ের মধ্যে বৈঠকের পরপরই ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি আইয়ুব শাসনবিরোধী আন্দোলনের বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপিত হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় যে, আইয়ুব খান কর্তৃক শাসনতন্ত্র ঘোষণার সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করবে এবং তারপর ক্রমে ক্রমে তা সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হবে। এ বৈঠকে আরো সিদ্ধান্ত হয় যে, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে কাজ করবে।
নিচে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের ধারা আলোচনা করা হলো :
১. সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতারের প্রতিবাদ : ১৯৬১ সালের শেষের দিকে মুজিব ও মানিক মিয়া এবং মণিসিংহ ও খোকা রায়ের মধ্যে বৈঠকের পরপরই ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয় এর প্রতিবাদে ১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। ধর্মঘট ১ ফ্রেব্রুয়ারি থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ৬ ফেব্রুয়ারি (ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন, পৃষ্ঠা- ৩০৯) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া প্রমুখ রাজনীতিবিদগণ এবং অনেক ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার সরকার করে। ফলে আইয়ুব শাসনবিরোধী আন্দোলন আরো বেগবান হয়ে উঠে।
২. সংবিধানবিরোধী আন্দোলন : সামরিক আইন চলাকালীন সময়েই ছাত্ররা আইয়ুব খান প্রণীত সংবিধানবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। কেননা, উক্ত সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানিদের দাবিদাওয়া চরমভাবে উপেক্ষা করা হয়। নাগরিকের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়, ভোটাধিকার সংরক্ষিত মৌলিক গণতন্ত্রী নামে একটি শ্রেণি সৃষ্ট
ি করা হয় যারা শাসকগোষ্ঠীর তল্পীবাহক হিসেবে কাজ করবে। উক্ত সংবিধান ঘোষিত হওয়া মাত্র পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ বিক্ষোভ, সমাবেশ এবং ক্লাস বন্ধ করে। সরকার এ সময় প্রচণ্ড আকারে ছাত্র দমন শুরু করে। বহুসংখ্যক ছাত্রনেতাকে এ সময় গ্রেফতার করা হয়। নতুন সংবিধানের আওতায় যে নির্বাচন ঘোষিত হয়েছিল ছাত্ররা তা বয়কট করে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাত্রদের নির্বাচন বয়কটের আহ্বানে সাড়া না দিলেও কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা হামিদুল হক চৌধুরী, নুরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, সৈয়দ আজিজুল হক, মোহামেনউদ্দিন আহমদ গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তি দাবি করেন। সে দাবিতেও
সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেনি। অবশেষে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হলে গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তি দেয়া হয়।
৩. ১৯৬২ শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন : ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বরে ছাত্ররা আরেকটি আন্দোলন সংঘটিত করেছিল তা ইতিহাসে ‘বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন’ নামে অভিহিত। আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের নামে যে চমক দেখান, শিক্ষা সংস্কারের চেষ্টা তার মধ্যে একটি। ১৯৫৯ সালের ৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান শিক্ষা সচিব ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক এম, এম শরীফকে সভাপতি করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিশন গঠন করেন। এটি শরীফ শিক্ষা কমিশন নামে খ্যাত। ১৯৬২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে শরীফ কমিশন রিপোর্ট প্রকাশ পায় এবং সরকার এর সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শরীফ কমিশন রিপোর্টকে ছাত্রসমাজ গণবিরোধী, প্রতিক্রিয়াশীল, শিক্ষা সংকোচন, শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে গণ্য, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নতুন ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা ব্যাপক প্রচারণা, সভা সমাবেশ, মিছিল, ধর্মঘট চালিয়ে যেতে থাকে। দ্রুত এ আন্দোলন সমগ্র প্রদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং আইয়ুব সরকারের ভিত নড়ে উঠে। এ কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম ঢাকা কলেজের ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল করে। তারা “ডিগ্রি স্টুডেন্টস ফোরাম” নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। এ ফোরামের ব্যানারে ছাত্রনেতৃবৃন্দ ঢাকা শহরের অন্যান্য কলেজেও প্রতিবাদ সভা করে এবং শীঘ্রই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতৃবৃন্দ এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৪. সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধ : ১৯৬৪ সালের ৭ জানুয়ারি সরকারের ইঙ্গিতে অবাঙালি মুসলমানেরা ঢাকা শহরে এবং আশপাশে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু করে। ১০ জানুয়ারি এ দাঙ্গা ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবং তা বাঙালি অবাঙালির দাঙ্গায় পরিণত হয়। এ দাঙ্গায় হিন্দুদের রক্ষা করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক নজরুল ফোরামের সভাপতি কবি আমির হোসেন চৌধুরী এবং ১৬ জানুয়ারি ঢাকায় নটরডেম কলেজের অধ্যাপক ফাদার নোভাক নিহত হন। ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার নেতৃত্বে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয় এবং কমিটির উদ্যোগে ১৭ জানুয়ারি ইত্তেফাক, সংবাদ ও দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ শিরোনামে একটি আবেদনপত্র প্রকাশ করা হয়। এতে ঢাকার সচেতন ছাত্রসমাজ দাঙ্গার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। বিশেষ করে ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরা দাঙ্গা প্রতিরোধ এবং দাঙ্গায় আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের কাজে আত্মনিয়োগ করে।
৫. নয় নেতার বিবৃতি : জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক একটানা ৪৪ মাস সামরিক আইনের দ্বারা দেশ শাসনের পর ১৯৬২ সালের ১ মার্চ তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে উপর থেকে নিয়ন্ত্রিত পরোক্ষ নির্বাচন। এক ব্যক্তি এক ভোট এবং কেন্দ্রীভূত নতুন শাসন জারি করে।
এ সংবিধানের অধীনে দলবিহীনভাবে মৌলিক গণতন্ত্রীদের দিয়ে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন করিয়ে ন
েয়া, ১৯৫৯ সালে সামরিক আদেশ বলে জারিকৃত EBDO—’Elective Bodies Disqualification Order’ আইনে অনেক রাজনৈতিক নেতাকে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করে। এমতাবস্থায় ১৯৬২ সালের ৪ জুন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন দলের নয় জন বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা একটি যুক্ত বিবৃতি দেন এটি নয় নেতার বিবৃতি নামে খ্যাত। এতে যারা স্বাক্ষর করেন তারা হলেন : নূরুল আমিন (মুসলিম লীগ) হামিদুল হক, আবু হোসেন সরকার, ইউসুফ আলী চৌধুরী ওরফে মোহন মিয়া, সৈয়দ আজিজুল হক ওরফে নান্না মিয়া (৪ জন কৃষক-শ্রমিক পার্টি), আতাউর রহমান ও শেখ মুজিবুর রহমান (আওয়ামী লীগ), মাহমুদ আলী (ন্যাপ), পীর মোহসেন উদ্দিন আহমেদ ওরফে দুদু মিয়া (নিজাম-ই-ইসলাম)। নয় নেতার বিবৃতি ছিল মূলত আইয়ুব খান প্রবর্তিত ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের প্রত্যাখ্যান।
৬. ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট : National Democratic Front মূলত কোন রাজনৈতিক দল ছিল না। এটি ছিল আইয়ুব বিরোধী একটি রাজনৈতিক মোর্চ বা প্লাটফর্ম। এর লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের জন্য একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র লাভ। NDF এর গঠন ছিল সময়ের দাবি। আইয়ুব দীর্ঘ সামরিক শাসন আমলে রাজনৈতিক দলের তৎপরতা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকে। ১৯৬২ সালের ১ মার্চ রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান একটি শাসনতন্ত্র জারি করলেও সামরিক শাসন প্রত্যাহার হয় আরো পরে। অবশেষে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করা হলেও রাজনৈতিক দলের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তখনও অব্যাহত থাকে। ১৯৬২ সালের ১৫ জুলাই রাজনৈতিক দল বিধির আওতায় কতিপয় শর্তসাপেক্ষে রাজনৈতিক দল গঠন বা পুনরুজ্জীবনের অনুমতি প্রদান করা হয়। এরপর ১৯৬২ সালের ৪ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের আইয়ুব সরকারবিরোধী সদস্যের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট নামে একটি গ্রুপ গঠিত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রকৃপক্ষে আইয়ুব সরকার আমলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ থাকায় কোন দল এককভাবে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। মূলত বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনই আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলন গড়ে তোলে এবং ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে।