১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলনের বর্ণনা কর।

অথবা, ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বিরোধী বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ বর্ণনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
পূর্ববাংলার ছাত্র আন্দোলন তথা জাতীয় আন্দোলন ও জাতীয় মুক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্ব ছিল সুদূরপ্রসারী। এ আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ফলাফল ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ছাত্র সমাজের এ আন্দোলন রাজনৈতিক শূন্যতাকে ভেঙে গোটা পরিবেশকে চাঙ্গা করে তোলে। নিচে ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলন বর্ণনা করা হলো :
১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন : আইয়ুব খান নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করতে এবং জনসাধারণের সমর্থন লাভের জন্য বিভিন্ন সংস্কার, পদক্ষেপ গ্রহণ করে তার মধ্যে অন্যতম ছিল ১৯৬২ সালের শিক্ষা
সংস্কার। আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসে ১৯৫৮ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক এস. এম. শরীফকে চেয়ারম্যান করে একটি কমিশন গঠন করেন এবং পাকিস্তানের পরবর্তী শিক্ষানীতি সম্পর্কে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব প্রদান করেন। ১৯৬২ সালের এ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। কমিশনের রিপোর্টে পাকিস্তানে ষষ্ঠ থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক, উর্দুকে সার্বজনীন ভাষায় রূপান্তর, উর্দু ও বাংলা ভাষার সম্পর্কে আরো ঘনিষ্ঠতর করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়।
শরীফ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সরকার ১৯৬২ সালে কতকগুলো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। যেমন-
ক. পাসকোর্স ও অনার্সের সময়গত পার্থক্য বিলোপ করা। ২ বছরের বি.এ. পাস কোর্স বাদ দিয়ে তিন বছরের বি এ পাস কোর্স চালু করা।
খ. স্কুল কলেজের সংখ্যা সীমিত করা।
গ. শিক্ষা খরচের ৮০% অভিভাবকদের বহন করতে হবে এর বাকি ২০% সরকার বহন করবে।
ঘ. অবৈতনিক শিক্ষার ধারাকে অবান্তর বলে ঘোষণা করে।
ঙ. পাকিস্তানের জন্য অভিন্ন কমিশনের জন্য সুপারিশ করে। উক্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হলে পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজ প্রতিবাদ শুরু করে। ঢাকা কলেজের ছাত্ররা প্রথমে এ রিপোর্টের বাতিল চেয়ে আন্দোলন শুরু করে। এদের দাবির সাথে পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা আন্দোলনের ডাক দেয়। ডিগ্রি স্টুডেন্টস ফোরাম নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়। ডিগ্রি স্টুডেন্টস ফোরাম পরবর্তীতে ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্ট ফোরাম এ পরিণত হয়। ১০ আগস্ট ঢাকা কলেজের ক্যান্টিনে স্নাতক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির ছাত্ররা এক সমাবেশে মিলিত হয়ে ১৫ আগস্ট দেশব্যাপী ধর্মঘট এবং ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দেয়। ১৫ আগস্ট দেশব্যাপী ধর্মঘট পালিত হয় এবং এদিন থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ১০ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারি করলে ১৭ সেপ্টেম্বর হরতালের ডাক দেয়া হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের নির্যাতনে কয়েকজন ছাত্র নিহত ও আহত হয়। এদিন কর্মসূচি সফল করতে গিয়ে যশোর, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের নির্যাতনে বহু ছাত্র আহত ও গ্রেপ্তার হয়। পরিস্থিতি অবনতি লক্ষ্য করে সরকার শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন স্থগিত করে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজ প্রকাশ্যে সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং শুরু করে। এ আন্দোলনে দেশবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম দেয়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি চাঙ্গা করে তোলে, আইয়ুব খানের মতো লৌহ মানব ছাত্র আন্দোলনের নিকট নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন।