পূর্ব পাকিস্তানিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক নীতিসমূহ আলোচনা কর।

অথবা, পাকিস্তানি শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম-পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক নীতির বিবরণ দাও ।
অথবা, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বৈষম্য ছিল তার বিবরণ দাও।
অথবা, পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের লোক তাদের ন্যায্য অধিকার ভোগ করবে এ চুক্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের প্রাপ্য ন্যায্য অধিকারের প্রতি মোটেই দৃষ্টি দেয়নি। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব হলো ১০০০ মাইল। দু’অঞ্চলের মধ্যে ছিল সবকিছুর ভিন্নতা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ঐক্যবন্ধন সুদৃঢ় করার একমাত্র উপায় ছিল একটি বৈষম্যহীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার বাস্তবায়ন। কিন্তু পাকিস্তানি সরকার প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে তা করেননি।
পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য : পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি শাসকগোষ্ঠী দু’অঞ্চলের দু’রকম নীতি অনুসরণ করেন। এর ফলে পশ্চিম পাকিস্তানে যেখানে উন্নতি হয়, পূর্ব পাকিস্তানে সেখানে দুর্বল হয়ে পড়েছে। নিচে বৈষম্যের কারণগুলো আলোচনা করা হলো :
রাজনৈতিক বৈষম্য : পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর বৃহত্তম অংশ পূর্ব পাকিস্তানে বাস করলেও দেশের রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপন করা হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি এবং পরে ইসলামাবাদের উন্নয়নের জন্য যেমন টাকা ব্যয় করা হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকার উন্নয়নের জন্য তার কিছুই করা হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানিরাই ছিলেন প্রকৃত অর্থে শাসন ক্ষমতার কর্ণধার। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানিদের কেনোকিছু করার ছিল না।
২. অর্থনৈতিক বৈষম্য : পূর্ব পাকিস্তানিদের দুর্দশার অন্যতম কারণ হলো অর্থনৈতিক বৈষম্য। সামরিক শাসনামলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক শোষণের মাত্রা পূর্বাপেক্ষা বৃদ্ধি পায়। ১৯৫৯-৬০ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মাথাপিছু আয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের তুলনায় ৩২% বেশি। ১০ বছর পরে এ পার্থক্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬১%। পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলার দরুন তেমন কোনো শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি।
৩. বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিময় ক্ষেত্রে বৈষম্য : বৈদেশিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে যে বৈষম্য বিরাজমান ছিল তার একটি তালিকা নিচে দেওয়া হলো :
৪. বৈদেশিক সাহায্য ক্ষেত্রে বৈষম্য : ১৯৬৫ সালে চীন পাকিস্তানকে ৬০ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার ঋণ দেয়। এর সিংহভাগ ব্যয় হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়নের জন্য ব্যয় হয় মাত্র ১,২৫,০০০ ডলার। এ সময়ে বিশ্বব্যাংক, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য প্রচুর ঋণ দেয়। এসব ঋণের বেশিরভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য খরচ করা হয়।
৫. কৃষি সংক্রান্ত উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৈষম্য : পূর্ব পাকিস্তান কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি উন্নয়নের ব্যাপারেও এখানে সীমাহীন বৈষম্য ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে একর প্রতি উৎপাদনের পরিমাণ পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়া এখানে বছরে ২/৩টি ফসল হয়। তাই কৃষির প্রতি নজর দিলে এখানে একটি গতিশীল অর্থনীতি গড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু
সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে অবহেলা করে পশ্চিম পাকিস্তানের কৃষিখাতে অকাতরে অর্থব্যয় করেছেন।
৬. বিদ্যুৎ উন্নয়নে বৈষম্য : বিদ্যুৎ উন্নয়নের কথাও বলা দরকার। ব্যাপক বিদ্যুতের ব্যবহার ও সরবরাহ জাতীয় অর্থনীতির সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করে। বিভিন্ন উপায়ে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ ছিল যথা ক্রমে ৮৩% ও ১৭%। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন বিদ্যুৎ উন্নয়ন পরিকল্পনায় বৈদেশিক সাহায্যের একটা বিরাট অংশ ব্যয় করা হতো। সিন্ধু অববাহিকায় দুটি বৃহৎ বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রায় ১,৮০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়। অথচ পূর্ব পাকিস্তান ওয়াপদার জন্য পাঁচ বছরের (১৯৫৯-৬৪) খরচ করা হয় ১,৪৫৩ মিলিয়ন ডলার।
৭. শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য : শিক্ষাক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে বৈষম্য দেখা যায়, তা ছিল অত্যন্ত বেদনাদায়ক। পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা যেখানে বৃদ্ধি পেয়েছিল, সেখানে বিদ্যালয়ের সংখ্যা আনুপাতিক হারে হ্রাস পেতে থাকে। অথচ এ একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিদ্যালয়ের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে ৪ গুণ বৃদ্ধি পায়।
৮. চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য : পাকিস্তানি শাসনামলে চাকরির ক্ষেত্রেও বৈষম্য বিদ্যমান ছিল। সামরিক ও বেসামরিক চাকরি প্রদানের ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানিদের বরাবর বঞ্চিত করা হয়। বিমান, নৌ সেনা, সদরদপ্তরগুলো ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। এসব দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে থাকায় পূর্ব পাকিস্তানের চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য ছিল।
৯. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যের বৈষম্য : পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে মূল্যগত বিরাট ব্যবধান ছিল। দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানে চাল ও গমের দর যথাক্রমে ৫০.০০ ও ৩৫.০০ টাকা প্রতি মণ ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে চালের দাম ছিল ১৮:০০ টাকা এবং গমের দাম ছিল মাত্র ১০০০ টাকা। সুতরাং, এ থেকে যে বৈষম্য ছিল তা বুঝা যায়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার আলোকে বলা যায়, যে উদ্দেশ্য নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য পাকিস্তানিরা চালান তা ছিল তাদের শোষণ ও নির্যাতনের পথ। তবে এক্ষেত্রে বৈষম্যের জন্য পাকিস্তানিরা বেশি দিন টিকে থাকতে পারেনি। এটা ছিল সাময়িক বিষয়। তবে তা পাকিস্তানিদের জন্য ছিল ভোগান্তিজনক। এ বৈষম্যের জন্যই পূর্ব
পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক চক্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ফলে সংঘটিত হয় ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান। আর এ অভ্যুত্থান থেকে পরবর্তীতে সংঘটিত হয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। আর এ সংগ্রাম থেকেই পরবর্তীতে বিশ্বের মানচিত্রে জন্ম নেয় একটি স্বাধীন, সার্বভৌম দেশের যা আজকের বাংলাদেশ।