১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে আর্থসামাজিক কাঠামো কেমন ছিল?

অথবা, ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের আর্থসামাজিক কাঠামোতে কেমন পার্থক্য বা বৈষম্য ছিল?
উত্তর৷ ভূমিকা :
১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের জন্ম। বিশাল ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম দুই প্রান্তে হাজার মাইলের ব্যবধানে দুই ভিন্ন ভূখণ্ড নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। একটি অংশের নাম পশ্চিম পাকিস্তান অপরটি পূর্ব বাংলা তবে ১৯৫৬ সালে তার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। এ দুটি অংশে শুধু দূরত্বগত পার্থক্য ছিল না। আর্থসামাজিক
কাঠামো থেকে শুরু করে অন্যান্য সকল ক্ষেত্রেই এ দুই অংশের পার্থক্য সুস্পষ্ট। পাকিস্তানের দুই অংশের আর্থসামাজিক কাঠামোর ধরন বা পার্থক্য বা বৈষম্য :
১. কেন্দ্র ও প্রদেশ : ভারতের পূর্ব প্রান্তের ভূখণ্ড নিয়ে পাকিস্তানের পূর্ব অংশ গঠিত হয়। জন্মলগ্নে এর নাম পূর্ব বাংলা ছিল কিন্তু ১৯৫৬ সালে সংবিধানে এর নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করা হয়। এটি পাকিস্তানের একটি প্রদেশ হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের পশ্চিমে ৪টি প্রদেশ যথা : পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং ৫টি
রাজ্য যথা : বেলুচিস্তান রাজ্য, ভাওয়ালপুর রাজ্য, খয়েরপুর রাজ্য, জুনাগড় রাজ্য এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত রাজ্য। ১৯৫৬ সালে এসব প্রদেশ ও রাজ্যকে একত্র করে একটি প্রদেশ এবং পাকিস্তানের কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়। পাকিস্তানের রাজধানী স্থাপন করা হয় পশ্চিমে পাকিস্তানের করাচিতে।
২. দুই প্রদেশের ভাষা ও সংস্কৃতির অমিল : পাকিস্তানের দুই অংশে ধর্মের মিল ছাড়া ভাষা ও সংস্কৃতির মিল ছিল না। পূর্ব বাংলায় ভাষা ছিল বাংলা, পশ্চিমের ভাষা ছিল উর্দু এবং রাষ্ট্র গঠনের সাথে সাথে উর্দুকে রাষ্ট্রীয় ভাষা ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের কারণে বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রীয় ভাষার সম্মান দেওয়া হয়।
৩. দুই প্রদেশের আয়তন ও জনসংখ্যা : পাকিস্তানের মোট আয়তনের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে আয়তন ছিল মোট পাকিস্তান ৮৪.৩ ভাগ এবং পূর্ব পাকিস্তানের ১৫.৭ ভাগ। অথচ মোট জনসংখ্যার ৫৬.৩ ভাগ জনগণ পূর্ব পাকিস্তান এবং ৪৩.৭ ভাগ জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাস করতো।
৪. উচ্চবিত্ত বা এলিট শ্রেণির অবস্থান : পূর্ব পাকিস্তানে উচ্চবিত্তদের অস্তিত্ব ছিল না বললেই চলে। ব্রিটিশ আমলে পূর্ব বাংলার উচ্চবিত্তরা ছিল জমিদারগোষ্ঠী তারা কলকাতায় বাস করতো। ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর তারা ভারতে চলে যান এবং তাদের সম্পত্তি ভারতে স্থানান্তর করেন। উপরন্তু ১৯৫০ সালে পূর্ব বাংলার মুসলমান জমিদারদের পতন ঘটে। সুতরাং পূর্ব বাংলার রাজধানী ছিল মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির হাতে। অপরদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে সামন্ততান্ত্রিক ভূমিব্যবস্থা ছিল তাই নেতৃত্ব প্রায় সামন্তবাদী জমিদার শ্রেণির হাতে ছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণির তেমন কোনো নেতৃত্ব ছিল না।
৫. শিল্পকারখানা ও ব্যবসায় বাণিজ্য : পশ্চিম পাকিস্তানে জন্মলগ্ন থেকে পূর্ব পাকিস্তান তুলনায় বেশি শিল্প কাঠামো, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, বৃহৎ বন্দর এবং সমৃদ্ধ কয়েকটি শহর ছিল। পক্ষান্তরে, পূর্ব পাকিস্তান উত্তরাধিকারসূত্রে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য শিল্পকারখানা পায়নি। ব্রিটিশদের সময় বাংলা পাট চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল কিন্তু অধিকাংশ পাট কারখানা গড়ে উঠেছিল কলকাতাকে কেন্দ্র করে। পূর্ব বাংলায় তেমন কোনো বড় মিল বা কারখানা ছিল না।
৬. সামরিক বাহিনী গঠন : পাকিস্তান জন্মের পর যে সামরিক বাহিনী গঠন করে তাতে সকল ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার জনগণের অংশগ্রহণ অত্যন্ত নগণ্য ছিল। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনীতে উচ্চ পর্যায়ে বাঙালি অফিসার একজনও ছিল না। এমনকি সাধারণ সিপাহিদের মধ্যেও বাঙালিদের অংশগ্রহণ ছিল অত্যন্ত কমসংখ্যক।
৭. প্রশাসনিক ক র্মকর্তা : সিভিল সার্ভিসেও বাঙালিদের চিত্র এক ছিল। সরকারি সকল উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি । পাকিস্তানের যাত্রার প্রথম থেকেই পাকিস্তানি আমলাতন্ত্র গঠিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানি এবং ভারত থেকে আগত মোহাজেরদের নিয়ে। পূর্বে পূর্ব বাংলার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে অধিকাংশ ছিল হিন্দু। উকিল, ডাক্তার,মমোক্তার, শিক্ষক প্রভৃতি পেশায় হিন্দুরা বেশি ছিল। দেশ বিভাগের পর তারা ভারতে চলে যায়। এর ফলে এ প্রদেশে দক্ষ কর্মকর্তাদের অভাব দেখা দেয়। এ অভাব পূরণ করে পাঞ্জাবের আমলাবৃন্দ ও ভারত থেকে আগত অবাঙালি মুসলমানরা। এ প্রসঙ্গে খালিক বিন সাঈদ মন্তব্য করবেন যে : “All the key positions in west Bengal administration were held by either Punjabi civil servants or Urdu speaking Muslim civil servants who had migrated form India.” অর্থাৎ, পূর্ব বাংলার সকল উচ্চপদ হয় পাঞ্জাবি আমলা দ্বারা নয় ভারত থেকে আগত উচ্চ উর্দু ভাষী মুসলমানদের দ্বারা দখল হয়েছে।
৮. ব্যবসায় বাণিজ্য : পশ্চিম পাকিস্তানি ও ভারত থেকে আগত মুসলমানরা বাংলায় চাকরি করতে আসলেও কেউ ব্যবসায় বাণিজ্য করতে বাংলায় আসেনি। যেসব মুসলমান রিফিউজি ভারত থেকে মূলধন নিয়ে এসেছিল তারা পশ্চিম পাকিস্তানে গমন করে এবং সেখানের শিল্পকারখানায় তা বিনিয়োগ করে। পূর্ব বাংলাকে এসব শিল্পকারখানার কাঁচামাল এর যোগানদার ও তৈরি পণ্যের বাজার হিসেবে ব্যবহার করে।
৯. অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণ : শক্তিশালী এলিট শ্রেণি সমৃদ্ধ পশ্চিম পাকিস্তানে সেখানে কেন্দ্রীয় শাসন কাঠামো তৈরি করে। কেন্দ্র ও প্রদেশে ক্ষমতা বণ্টনে অনীহা করে। তাদের স্বার্থ উদ্ধারের উদ্যোগে অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়ন করা হতো। বাজেট প্রণয়নের লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলা থেকে সম্পদ আহরণ। বাজেটের বরাদ্দ অর্থের ক্ষেত্রে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। বাজেটের বাইরেরও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বিপুল অর্থব্যয় হতো।
১০. অবকাঠামো উন্নয়ন : পশ্চিম পাকিস্তানের রাস্তাঘাট, কলকারখানা, ব্রিজ ইত্যাদির উন্নয়ন পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় অনেক বেশি ছিল। এক্ষেত্রে তাদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ বৈষম্যমূলক ছিল ।.
১১. কেন্দ্রীয় নেতা : ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি। ভারত থেকে আগত মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ পশ্চিম পাকিস্তানে গমন করে। বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীও করাচিতে চলে যান। গণপরিষদে বাংলার কোটা থেকে ভারত থেকে আগত নেতাদের আসন দেওয়া হয় ফলে বাংলার নেতৃত্ব আরো কমে যায় ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রশাসনে, সেনাবাহিনী, অর্থনীতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ণ এবং একচেটিয়া কর্তৃত্ব থাকায় পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই তার রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে ভারসাম্যের অভাব দেখা দেয়। পরবর্তীতে এ ভারসাম্যহীনতার ফলে যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয় তা থেকে উত্তরণের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন আন্দোলন সংঘটিত হয় এবং শেষ পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্র গঠন করে।