অথবা, আশার গঠন কাঠামো উল্লেখপূর্বক এর কার্যক্রমসমূহ আলোচনা কর।
অথবা, আশার গঠন কাঠামো তুলে ধর। আশা কার্যক্রমের বিবর্তন সম্পর্কে বর্ণনা কর।
উত্তর।৷ ভূমিকা : আশা একটি বেসরকারি স্বেচ্ছামূলক সমাজকল্যাণ সংস্থা। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হতে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের লক্ষ্য নিয়ে বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি স্বেচ্ছামূলক সংস্থা এদেশে সীমিত পর্যায়ে কাজ শুরু করে। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে শুধু সরকারি সংস্থাগুলো দেশ পুনর্গঠনে অনেকটাই ব্যর্থ হয়।এ অবস্থার প্রেক্ষিতে আশির দশকে বিভিন্ন স্বেচ্ছামূলক সংস্থা এদেশে ব্যাপকভাবে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। তৃণমূল পর্যায়ে সেবা পৌছে দেয়া, দরিদ্র ও ক্ষুধামুক্ত সুন্দর সামাজিক জীবন উপহার দেয়া এবং বঞ্চিত ও অধিকার হারা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই তখন এসব সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে।আশাও এমনি একটি সমাজকল্যাণমূলক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
আশার গঠন কাঠামো : আশা বাংলাদেশের সবগুলো জেলায় তার কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেছে। বর্তমানে আশা ৬৪ জেলার ৫০৩টি থানার ৪৭,৬০৬টি গ্রামে তার কর্মসূচি পরিচালনা করছে। পল্লি এলাকায় ১,৫০৩টি এবং শহর এলাকায় ২২২টি শাখা স্থাপনের মাধ্যমে আশা কাজ করে যাচ্ছে। আশার কার্যাবলি পরিচালনার জন্য রয়েছে সাধারণ পরিষদ (General Body)। সাধারণ পরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা সাত জন। তাছাড়া রয়েছে ম্যানেজমেন্ট টিম লিভারস এবং সেকশন প্রধানগণ। এদের সংখ্যা ৯। উল্লেখ্য আশার সাধারণ পরিষদের সাত জন সদস্যের মধ্যে রয়েছেন একজন সভাপতি, একজন কোষাধ্যক্ষ, চার জন সদস্য এবং একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। অপরদিকে, ব্যবস্থাপনা দলনেতা (Management Team Leaders) এবং সেকশন প্রধানদের মধ্যে রয়েছেন একজন প্রতিষ্ঠাতা (এম ডি), একজন জি এম (SEL), একজন জি এম (কর্মসূচি), একজন জি এম (AL), একজন জি এম (অডিট), একজন পরিচালক (গবেষণা), একজন প্রধান (অর্থ), একজন প্রধান (প্রশাসন ও হিসাব) এবং একজন দলনেতা (Team Leader)। সার্বিকভাবে আশার সাংগঠনিক কাঠামো নিম্নরূপভাবে দেখানো যেতে পারে :
আশা কার্যক্রমের বিবর্তন : আশা কর্মসূচি কতকগুলো বিবর্তনমূলক পর্যায় অতিক্রম করে বর্তমান পর্যায় পর্যন্ত পৌছেছে। আশার পর্যায়ক্রমিক বিবর্তন নিয়ে উপস্থাপন করা হলো :
১. সামাজিক আন্দোলন পর্ব (১৯৭৮-১৯৮১) : এটি আশা কর্মসূচি বিবর্তনের প্রথম পর্ব হিসেবেও উল্লেখ করা হয়।এটি একটি অভিজ্ঞতার পর্যায়ও বটে। এ পর্বের কার্যক্রমকে আশার সামাজিক আন্দোলন (Social Action) পর্ব নামেও অভিহিত করা হয়। এ পর্বে আশা মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় থানার টেপরা গ্রাম থেকে তার কর্মসূচি শুরু করে।তখন আশার নাম ছিল ‘সমাজ প্রগতি সংস্থা’। ১৯৭৯ সালে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় Association for Social Advancement বা সংক্ষেপে আশা (ASA)। ১৯৭৮-১৯৮১ সাল পর্যন্ত ভিত্তি পর্যায়ে আশা প্রধানত যে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল তা হচ্ছে-
i. ভূমিহীনদের সংগঠিতকরণ,
ii. সচেতনতা সৃষ্টি,
iii. সামাজিক কর্মকাণ্ডে জনগণের অংশগ্রহণ,
iv. অধিকার আদায়ে নেতৃত্বদান,
v. সেবা সহায়তা কর্মসূচির মধ্যে যোগাযোগ ইত্যাদি।
আশার এ সামাজিক আন্দোলনের ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কয়েকটি থানায় কয়েক হাজার দল গঠন করা সম্ভব
হয়। অনেক ভূমিহীন ভূমিতে তাদের অধিকার খুঁজে পায়, মানুষ অধিকার সচেতন হয় ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে তাদের অংশগ্রহণ প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
২. প্রশিক্ষণ পর্ব (১৯৮১-১৯৮৫) : ১৯৮১ থেকে ১৯৮৫ সালের কার্যক্রমকে প্রশিক্ষণ পর্ব (Training Phase) হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এ পর্যায়ে আশা নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করে। এ পর্যায়ে বর্ণবোধ ও বর্ণ পরিচয় নামক দুটি গ্রন্থের মাধ্যমে নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে সচেতন করে তোলা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা, পুষ্টি উন্নয়ন, মানব উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষাদান করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য।
৩. কর্মসূচি বৃদ্ধি পর্ব (১৯৮৫-১৯৮৮) : ১৯৮৫-১৯৮৮ সাল পর্যন্ত আশার কর্মসূচিকে বৃদ্ধি পর্ব (Programme Increase Phase) বলেও অভিহিত করা হয়। এ সময় থেকেই আশার কার্যক্রম বিস্তৃত হয়। যেসব কারণে এ সময়টাকে আশার কর্মসূচি বৃদ্ধি পর্ব বলে অভিহিত করা হয় সে কারণগুলো হচ্ছে-
i. এ পর্বে আশার কর্মসূচিতে নতুনভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কার্যক্রম চালু হয়।
ii. এ পর্বে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসূচি যুক্ত হয়।
iii. অসহায় ও দরিদ্রদের সেবার জন্য Part time ডাক্তার নিয়োগ করা হয়।
iv. এ সময় থেকেই ক্লিনিক্যাল সেবা চালু করা হয়।
v. এ সময়ে মধ্যে আশার কর্মসূচি মানিকগঞ্জ জেলা ছাড়াও টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও হবিগঞ্জ জেলায় সম্প্রসারিত হয়।
৪. ঋণ কর্মসূচি পর্ব (১৯৮৮-১৯৯১) : যদিও ঋণ কর্মসূচি এখন পর্যন্ত আশার সবচেয়ে উলেখযোগ্য কর্মসূচি তবুও ১৯৮৮-১৯৯১ সাল পর্যন্ত সময়কালকে আশার ঋণ কর্মসূচি পর্ব (Loan Programme Phase) বলে অভিহিত করা হয়।কেননা এ সময়ের মধ্যেই আশার ঋণ কর্মসূচি বিস্তৃত হয়। ১৯৮৮ সালের শেষ দিকে এ কর্মসূচি চালু হয়। এ পর্বে-
i. আশার কর্মসূচির কৌশলগত দিক পরিবর্তন করা হয়।
ii. ব্যাপক ভিত্তিতে ঋণদান কর্মসূচি চালু হয়।
iii. কর্মসূচিগুলো প্রধানত পুরুষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়।
৫. আত্মনির্ভরশীলতা উন্নয়ন মডেল পর্ব (১৯৯১-১৯৯৮) : ১৯৯১-১৯৯৮ সাল পর্যন্ত আশার কর্মসূচিকে আত্মনির্ভরশীল উন্নয়ন (Self-Relience Development Model Phase) বলে অভিহিত করা হয়। এ সময়ে আশার উন্নয়ন মডেলে বর্তমান পদ্ধতিতে ঋণ কর্মসূচি চালু হয়। আশার এ উন্নয়ন মডেল ঋণ কর্মসূচি বাংলাদেশসহ বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করে।এ মডেলের মূলকথা হলো আয় থেকে ব্যয় নির্বাহ করা। আশার আত্মনির্ভরশীল মডেলের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হলো :
i. দল গঠনের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
ii. এ মডেলটি মূলত ভুল ও প্রচেষ্টা প্রক্রিয়ায় এসেছে।
iii. মহিলা ও পুরুষদের জন্য পৃথক সমিতি গঠনের ব্যবস্থা করা হয়।
iv. ১৫-২৫ জনকে নিয়ে একটি করে সমিতি গঠিত হয়।
v. সংস্থার নিয়ম পালন ও নিয়মিত সাপ্তাহিক সঞ্চয় জমা দিলে ১২ সপ্তাহের মধ্যে একজন ঋণ পেতে পারে।
vi. প্রথম দফায় সর্বোচ্চ ৪,০০০ টাকা ঋণের ব্যবস্থা করা হয়।
vii. বিতরণকৃত ঋণ হিসেবে আসল টাকার ১২.৫০% সার্ভিস চার্জ ধরে মোট প্রদেয় ঋণ নির্ণয় করা হয়।
viii.প্রদেয় ঋণকে সাপ্তাহিক সমান ৪৫ কিস্তিতে আদায় করতে হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, আশা বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করে তোলার ক্ষেত্রে যে উদ্যোগ হাতে নিয়েছে সত্যিকার অর্থেই তা প্রশংসার দপবিদার। “গত ১৪ বছর ধরে আশা লক্ষ লক্ষ দরিদ্র নারীকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহায়তা দিয়ে আসছে। প্রায় ৩০ লক্ষ দরিদ্র পরিবার আশার ঋণ সহযোগিতায় জীবন পরিবর্তনের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। স্বল্প সুদে গ্রামের নারীরা হাঁস-মুরগি, ছাগল পালন, মাছ চাষ, গাভী পালন ও কুটিরশিল্প করে তাদের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আশা এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে, আর যার আদায়ের হার ৯৯ শতাংশ। ২০০৫ সালে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ দেবে বলে আশা স্থির করে।