অথবা, স্বাধীনতা অর্জনে বাংলা ভাষার অবদান উল্লেখ কর।
উত্তর৷ ভূমিকা : বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ও স্বাধীনতা অর্জনে বাংলা ভাষার তাৎপর্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ’ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবিভূর্ত হয় । পাকিস্তান বিভক্তির অন্যতম কারণ ছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলন। বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার চেতনা ও প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। ভাষা আন্দোলন হতেই বাঙালি জাতি আত্মসচেতন হয়ে উঠে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মাতৃভাষা আন্দোলনই বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম বহিঃপ্রকাশ যা সংক্ষেপে হলো ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত হয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা বা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বাংলা ভাষা মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
স্বাধীনতা অর্জনে বাংলা ভাষার ভূমিকা : বাংলা ভাষা সংস্কৃতির উপর নির্ভর করে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠে। নিচে এ সম্পর্কে বর্ণনা করা হলো :
১. জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি : ভাষাকে কেন্দ্র করেই জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি হয়। সমগ্র বাংলাদেশিরা ভাষাকে কেন্দ্র করে আত্মসচেতন হয়ে উঠে। অধিকার ও দাবি আদায়ে তারা একতাবদ্ধ হয় এবং তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবোধ সুদৃঢ় হয়।
২. জাতীয় চেতনা সৃষ্টি : পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ লোক বাংলায় কথা বলত। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকবর্গ বাংলা ভাষাকে অবহেলা করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র করে। এরই বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ প্রলয়ংকারী গর্জনে ও প্রতিবাদে এ হীনষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করে। ভাষাকে কেন্দ্র করে নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটে। বাংলা ভাষা বাঙালিদের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে তীব্রভাবে জাগ্রত করে।
৩. অধিকার সচেতনতা : বাংলা ভাষা বাংলাদেশিদের অধিকার আদায়ে সচেতন করে তোলে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে চেতনাবোধ জাগ্রত হয় তা সমগ্র বাঙালি জাতিকে অধিকার সচেতন করে তোলে। ভাষা আন্দোলন আজও জাতিকে অনুপ্রাণিত করছে, উজ্জীবিত করছে অধিকার আদায়ের সর্বাত্মক সংগ্রামে ঝাঁপিড়ে পড়তে, যা স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হয়।
৪. শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ : পাকিস্তানি শাঁসকগোষ্ঠী শুরু থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে নানাভাবে দমন ও নির্যাতন চালিয়ে দুর্বল করে রাখার কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু প্রতিবাদী বাঙালি জাতি জুলুম, শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। স্বাধীনতা অর্জনে বলীয়ান হয় এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
৫. একাগ্রতা সৃষ্টি : বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের জন্য তারা জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করে, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
৬. আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি : বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে যে রক্তাক্ত ঘটনা ঘটে তা সারাদেশে তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে এর সত্য প্রতিষ্ঠায় বাঙালি জাতির আত্মবিশ্বাস সুদৃঢ় হয়। ব্যক্তি স্থান ও গোষ্ঠী স্বার্থের বিরুদ্ধে তীব্র গতিতে আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে, যার পরিণতিতে বাংলা স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়।
৭. ছাত্রসমাজের দুর্বার আন্দোলন : বাংলা ভাষা আন্দোলন মূলত ছাত্রসমাজ কর্তৃক পরিচালিত হয়। বাংলার স্বাধীনতা ও দাবি প্রতিষ্ঠায় প্রতিটি আন্দোলনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।
৮. মধ্যবিত্ত এলিট শ্রেণির প্রভাব : বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র
করে পূর্ব বাংলায় একটি রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় মধ্যবিত্ত এলিট শ্রেণির গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। ভাষা আন্দোলনে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবৃত্ত শ্রেণি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে। এ কারণে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণি পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
৯. অন্যান্য আন্দোলনে মূল প্রেরণা : ভাষা আন্দোলন স্বাধীনতা অর্জনে এবং অন্যান্য আন্দোলনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে এবং মূল অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, রাষ্ট্রটির শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০ এর নির্বাচনে ভাষা আন্দোলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যা স্বাধীনতা অর্জনে মূল উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছিল ।
১০. স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রেরণা : বাংলা ভাষা আন্দোলন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীনতা অর্জন ও সার্বভৌমত্ব সৃষ্টিতে অনুপ্রেরণা যোগায়। ভাষা আন্দোলন প্রথম বারের মতো বাংলাদেশিদের স্বাধিকার আন্দোলনের অগ্নি শপথে দীক্ষিত করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হতে অনুপ্রেরণা যোগায়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অত্যন্ত অপরিহার্য। ভাষা আন্দোলন প্রথমে একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রূপ লাভ করে এবং পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার চিন্তা চেতনা শুরু হয় ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই। কাজেই স্বাধীনতা ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বাংলা ভাষা মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।