বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিবর্তন ধারা উল্লেখ কর।

অথবা, বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও বিবর্তন ধারা সম্পর্কে যা জান লিখ।
অথবা, বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশের ধারা পর্যালোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ভাব প্রকাশের প্রধান বাহক হলো ভাষা। মানুষ তার ভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করার জন্য বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে যে অর্থপূর্ণ ধ্বনি উচ্চারণ করে তাই ভাষা। কাজেই মানবজীবনে ভাষা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ভাষা হলো যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম যা সামগ্রিক জীবনধারাকে প্রভাবিত করে।
বাংলা ভাষার বিবর্তন ধারা : বাংলা লিপি ব্রাহ্মীলিপি থেকে উৎপন্ন। দীর্ঘদিনের পথপরিক্রমায় বাংলা ভাষা সমৃদ্ধ হয়েছে। নিচে বাংলা ভাষার বিবর্তন ধারা আলোচনা করা হলো :
অধিকাংশ ভাষাবিদ এর মতে, বাংলা ভাষার উদ্ভব হয় দশম শতাব্দীতে। তবে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটে। দশম থেকে চতুর্দশ শতাব্দীকে বাংলা ভাষায় আদিস্তর বলা হয়। বাংলাদেশি ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বিহার উড়িষ্যা ও আসামের কয়েকটি অঞ্চলের মানুষের ভাষা হলো বাংলা ।
বাংলা ভাষা উদ্ভবের ইতিহাস : ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা (৫০০০-৩৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) → শতম ভাষা → আর্যভাষা → প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা → প্রাচীন ভারতীয় আর্য কথ্য → প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃতে → গৌড়ী প্রাকৃতে (মাগধী প্রাকৃতের প্রাচ্যতর রূপ) → গৌড় অপভ্রংশ → বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস
তিন ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা :
১. আদি বা প্রাচীন যুগ,
২. মধ্যযুগ ও
৩. আধুনিক যুগ ।
১. আদি বা প্রাচীন যুগ : আদি বা প্রাচীন যুগের বাংলা ভাষার কাল দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত। এ সময়ের প্রধান নিদের্শক হলো চর্যাপদ। এর ভাষা থেকে তখন পর্যন্ত তার পূর্ববর্তী অপভ্রংশের প্রভাব দূর হয়ে যায়নি। এমনকি প্রাকৃতের প্রভাবও তাতে বর্তমান ছিল। তবে এখানেই বাংলা ভাষা তার স্বতন্ত্র মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। চর্যাপদ, ডাক ও খনার বচন এ যুগের সৃষ্টি।
২. মধ্যযুগ : মধ্যযুগের বাংলা ভাষার পরিধি ১২০১ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত। ত্রয়োদশ শতকের কোনো নিদর্শন পাওয়া না গেলেও এ সময়ে বাংলা ভাষা বিবর্তিত হচ্ছিল বলে মনে করা হয়। মধ্যযুগের প্রথম গ্রন্থ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন । মধ্যযুগের আদিস্তর চৌদ্দ পনেরো শতক পর্যন্ত এবং ষোলো, সতেরো, আঠারো শতক অন্ত্যযুগ। মধ্যযুগে বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধিত হয়। ধর্মীয় সাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলি, মঙ্গলকাব্য, নাথ সাহিত্য, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা উৎকর্ষ সাধন করেছিল।
৩. আধুনিক কাল : আধুনিক কালের স্তর হলো ১৮০১ সাল থেকে শুরু হয়ে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত প্রবহমান। এ যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বাংলা গদ্যের বিকাশ। গদ্যের দুটি রূপ সাধুরীতি ও চলিত রীতির উদ্ভব। স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের স্বতন্ত্র গৌরব নিয়ে এ আধুনিক যুগের শুরু। বইপত্র মুদ্রণের জন্য ছাপাখানা, পাঠ্যপুস্তক, ধর্মগ্রন্থ, জ্ঞানবিজ্ঞান, পত্র পত্রিকা
ছিল আধুনিক যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ যুগে যৌক্তিকতা, মানবিকতার বিকাশ ঘটে। নাটক, উপন্যাসে আসে মৌলিকত্ব, দেশপ্রেম জাতীয়তাবোধ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলা ভাষার উৎপত্তি ও ক্রমবিবর্তন একটি জটিল প্রক্রিয়া। ভাষার ধর্মই হলো পরিবর্তন হওয়া। বাংলা ভাষার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে তার পরিবর্তন ঘটেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের নিজস্ব পরিসরে স্বকীয় ভাষা প্রয়োগ রীতি অনুপ্রবেশ করে এখনকার বাংলা ভাষাকে ক্রমেই সমৃদ্ধি ও স্বাতন্ত্র্য দান করছে।