ভৌগোলিক অবস্থানের আলোকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস বর্ণনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ভৌগোলিক অবস্থান মূল্যায়ন কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি একটি ঐতিহাসিক বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান রূপ লাভ করেছে। প্রাচীনকালের বাংলা নামে কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড ছিল না। গৌড়, রাঢ়, পুণ্ড্র, হরিকেল, সমতট প্রভৃতি জনপদের সমষ্টি ছিল বাংলা। সর্বপ্রথম ঋগ্বেদের ‘ঐতরেয় আরণ্যক’-এ বঙ্গ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া মহাভারত, রামায়ণ এবং কালীদাসের রঘুবংশ-এ ‘বঙ্গ’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। সমগ্র বাংলা বঙ্গ নামে ঐক্যবদ্ধ হয় পাঠান আমলে। এছাড়া জটাপদে বাঙালিদের বাঙ্গাল বলে উল্লেখ করেছে। বাংলা নামের উৎপত্তি আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে উল্লেখ পাওয়া যায়। কাজেই বিভিন্ন বিদেশি শাসকগণ বিভিন্ন সময় বাংলা শাসন করেছে ফলে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এক বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে।

ভৌগোলিক অবস্থানের আলোকে বাংলাদেশের অভ্যুদয় : বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থা । নিচে ভৌগোলিক অবস্থানের আলোকে বিভিন্ন যুগে বাংলার অবস্থান আলোচনা করা হলো :
১. ১০০০-৭০০ খ্রিষ্টপূর্বে বাংলার অবস্থান : বাংলার সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদের ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ গ্রন্থে। তখন বাংলার একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এবং এর অধিবাসীদের নির্দিষ্ট নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ছিল। এসব অঞ্চলে প্রাক আর্যদের বসবাস ছিল উত্তর ও পশ্চিম ভারতে। প্রাক আর্যদের সময়ে বঙ্গের বেশিরভাগ অঞ্চল ছিল অরণ্যভূমি। অরণ্যময়
থাকার কারণে আর্য মুক্ত ছিল। বঙ্গ ও পুণ্ড্র বিখ্যাত জনপদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
২. বাংলার অবস্থান ৫৬০-৩২৫ খ্রিষ্টপূর্ব : প্রাচীনকালে মধ্যভারতে অনেকগুলো রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটে। কতকগুলো রাজনৈতিক অবস্থান যেমন- অঙ্গ, পুণ্ড্র, সূক্ষ্ম এবং বিশেষকরে বঙ্গ বিকাশের সাথে সাথে প্রাগৈতিহাসিক রাজ্যের উত্থান ঘটে। অঙ্গ ও পুণ্ড্রের ব্যাপক অংশ এবং বঙ্গের বেশকিছু অংশ মগধ রাজ্যভুক্ত হয়। গাঙ্গেয় নদীমালায় নৌপথকে কেন্দ্র করে বাংলা জনপদের বিকাশ ঘটে। নদী ও নৌপথকেন্দ্রিক জনপদের বিকাশ ঘটে। এ সময় বৌদ্ধধর্মের বিকাশ লাভ
করে বাংলা অঞ্চলে।
৩. কুষান যুগে বাংলার অবস্থান ৩০০-১০০ খ্রিষ্টপূর্ব : ৩০০-১০০ শতকের মধ্যে এশিয়ায় আগমন করে যাযাবর ভিত্তিক কুষানগণ। আর্য সভ্যতার সংস্পর্শে আসে এ কুষানগণ। উত্তর ভারতের উন্নত সংস্কৃতির সাথে মিশে উত্তর ভারতের গঙ্গা নদী বরাবর ব্যাপক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং রাজশক্তি গড়ে তোলে। এর ফলে রাজনৈতিক অঞ্চল প্রাগ জ্যোতিষের
অবনতি ঘটে।
৪. গঙ্গারিডই : আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণকালে বাংলায় গঙ্গারিডই নামে এক শক্তিশালী ও সমৃদ্ধিশালী রাজ্য ছিল। পণ্ডিতদের ধারণা গঙ্গা নদীর যেরা ভাগীরথী ও পদ্মা নামে পরিচিত এর মধ্যবর্তী স্থানে গঙ্গারিডই জাতির লোক বসবাস করত। এ রাজ্যের রাজধানী ছিল বঙ্গ নামে একটি বন্দর নগর।
৫. রাজা শশাঙ্ক এর বাংলা : প্রাচীনকালে এদেশকে বঙ্গ নামে অভিহিত করা হতো। গুপ্ত সাম্রাজ্য পতনের পর বঙ্গদেশ দুটি স্বাধীন অংশে বিভক্ত হয়। প্রাচীন বঙ্গ রাজ্য ও গৌড়। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলার রাজধানী ছিল বঙ্গ রাজ্য এবং বাংলার পশ্চিমাংশ ও উত্তরাংশ হয়েছিল গৌড়। গৌড়ের প্রথম স্বাধীন সার্বভৌম রাজা হলো শশাঙ্ক। শশাঙ্ক
প্রথম বাঙালি রাজা ।
৬. পরিব্রাজকদের দৃষ্টিতে বাংলার অবস্থান : ফা-হিয়েন, ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাং, মা হুয়ান, নিকল দ্য কনি ফেইসিন, হযরত শাহজালাল প্রমুখ পরিব্রাজক বাংলার অবস্থান, সংস্কৃতি ও রাজ্য সম্পর্কে ধারণা প্রদান করেন।
৭. পাল যুগে বাংলা (৭৫৬-৭৮১): গোপাল ছিলেন পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন উত্তর বঙ্গের একজন শক্তিশালী রাজা। ধর্মপাল ছিলেন শ্রেষ্ঠ পাল রাজা। তিনি বাংলা থেকে পাঞ্জাবের জলন্ধর পর্যন্ত সমগ্র উত্তর ভারতে রাজ্যবিস্তার করেছিলেন। পাহাড়পুরের বৌদ্ধ বিহার, সোমপুর বিহার তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিক্রমশীলা বিহারও প্রতিষ্ঠা করেন।
৮. সেন যুগের বাংলা : সামন্ত সেনের পুত্র হেমন্ত সেন রাঢ় অঞ্চলে সেনরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার পুত্র বিজয় সেন রাজ্যকে সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। বিজয় সেন সর্বপ্রথম বাংলাকে একক শাসনাধীনে আনয়ন করেন। তার দ্বিতীয় রাজধানী ছিল বিক্রমপুর।
৯. বাংলায় মুসলিম শাসন : বাংলায় মুসলিম শাসন শুরু হয় ১২০৪ সালে। বখতিয়ার খিলজি বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। ১৩৩৮ সালে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ সোনারগাঁয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৩৪২ সালে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ত্রিপুরা, নেপাল, উড়িষ্যা, বারানসী জয় করেন এবং ১৩৫২ সালে পূর্ববঙ্গ জয় করে উভয় বঙ্গ একত্রিত করেন। তিনি এ ভূখণ্ডের নামকরণ করে মূলক-ই-বাঙ্গালাহ নাম ঘোষণা করেন।
১০. মুঘল আমলে বাংলা : মুঘল আমলে বাংলা ছিল বৈচিত্র্যময়। সর্বপ্রথম বাংলার বারোভুঁইয়ারা মুঘল শাসন মেনে নেয়নি। ফলে তারা অনেক সময় স্বাধীন থেকেছে। ১৮ শতকের শেষের দিকে আওরঙ্গজেবের শাসনামলে এ সম্প্রসারণ চড়ান্ত পর্যায় ঘটে। বাংলার শাসকগণ মুঘল সম্রাজ্যের শাসনের বশ্যতা স্বীকার করে সুবাহ বাংলা হিসেবে অঞ্চলটি নিরাপত্তা লাভ করে। বাংলা যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে এবং পুনরায় ১৬৬১ খ্রিষ্টাব্দে কুচবিহার এবং ১৬১২ -১৩ খ্রিষ্টাব্দে অহোম ও আসাম পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে। দক্ষিণে উত্তর উড়িষ্যা পর্যন্ত বাংলার সীমান্ত ছিল।
১১. ইউরোপীয়দের আগমনের সময় বাংলা : ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষে আগমন করে ব্যবসায় বাণিজ্য করার লক্ষ্যে। পর্তুগিজ, ফরাসি, ডাচ ও ইংরেজরা আগমন করে উপমহাদেশে তাদের কর্মকাণ্ড বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে লিপ্ত হয়। ব্রিটিশ ভূ-জরিপবিদ জেমস রেনেল সর্বপ্রথম ভারতের মানচিত্রে বাংলাকে বেঙ্গল বলে চিহ্নিত করেন। এ মানচিত্রে বেঙ্গলের বিস্তৃতি পশ্চিমে অযোধ্যার সীমান্তবর্তী বেনারস এবং বিহার থেকে পূর্বে নিম্ন আসাম ও সিলেট এবং উত্তরে নেপাল ও ভূটান সীমান্ত থেকে দক্ষিণে উত্তর উড়িষ্যার নিকট মেদিনিপুর এবং বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত।
১২. ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে বাংলা : ব্রিটিশরা বাংলার সিংহাসন দখলের প্রচেষ্টা শুরু করে। তারা রাণিজ্য করার পাশাপাশি রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের পথ প্রশস্ত করে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনক্ষমতা লাভ করে এবং ১৭৬৫ সালে বাংলার দেওয়ানি লাভ করে।
১৩. ১৮৫৭ সালের বাংলা : সিপাহিবিদ্রোহের পর ভারতের শাসনব্যবস্থা ব্রিটিশ রাজ্যের হাতে চলে যায়। বাংলার একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি তৈরি করা হয়।
১৪. ১৯০৫ সালের বাংলা : রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কারে ১৯০৫ সালে বাংলার বিভক্তি ও পুনর্গঠন হয়। পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে গঠিত হয় নতুন প্রদেশ। এর নাম হয় পূর্ব বাংলা ও আসাম।
১৫. ১৯১১ সালের বাংলা : ভারত বিভক্তের ফলে কংগ্রেসের আন্দোলনের মুখে ১৯১১ সালে পূর্ব বাংলা ও আসাম এবং পশ্চিম বঙ্গ একত্রীভূত হয়।
১৬. ১৯৪৭ সালের বাংলা : লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভর করে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান ছিল পূর্ব বাংলা। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলা ছিল পাকিস্তানের একটি প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান।
১৭. বর্তমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ : দীর্ঘ ৯ মাস ধরে যুদ্ধ করে অবশেষে উদিত হয় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দমন, নির্যাতন, বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ গণআন্দোলন গড়ে তোলে। তার চূড়ান্ত পরিণতি হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জিত হয়।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, প্রাচীনকাল থেকে নানা পথ ও পরিক্রমার মধ্য দিয়ে বিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলার এ ভূখণ্ডের রয়েছে সুদীর্ঘ দিনের জয়পরাজয়ের ইতিহাস।