বাংলাদেশের ইতিহাসে ভৌগোলিক প্রভাব আলোচনা কর।

অথবা, `বাংলাদেশের জনজীবনে ভূপ্রকৃতির প্রভাব আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রা ও কর্মকাণ্ড তার ভৌগোলিক পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বসবাসরত মানুষের জীবন প্রণালি ক্রিয়া কার্যের সাথে ভৌগোলিক সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ও নিবিড়। ভৌগোলিক অবস্থার কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকমের মানুষ ও তাদের আচার বিশ্বাস ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। ভূপ্রকৃতির কারণে কোথাও মানুষ বর্বর, সাহসী, কর্মঠ আবার কোথাও অলস, অকর্মঠ। ভূপ্রকৃতির কারণে কোথাও উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ দেখা যায় আবার কোথাও অনুন্নত দেশ দেখা যায়। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কোনো জীবনযাত্রা সহজ ও সাবলীল আবার কোথাও বন্ধুর প্রকৃতির। তবে সবচেয়ে বেশি ভৌগোলিক প্রভাব লক্ষ করা যায় বাংলাদেশের ইতিহাসে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ভৌগোলিক প্রভাব : নিচে বাংলাদেশের ইতিহাসে ভৌগোলিক প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো :
১. প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যূহ : বাংলাদেশের নদনদী, খালবিল ও জলাভূমিসমূহ এর সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যূহের ন্যায় কাজ করত। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মহানন্দা, কুশী ও তাদের অসংখ্য উপনদী এবং শাখাপ্রশাখা অতিক্রম করে সেই যুগে একটি শত্রু বাহিনীর পক্ষে সহজসাধ্য ছিল না। তাইতো বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী উত্তর সীমান্তের প্রবেশদ্বারে একটি বিরাট শত্রু বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখতে পারত।
২. বাংলাদেশ তথা বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার ক্ষেত্রে প্রভাব : প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার আশ্রয় নিয়ে এবং ভৌগোলিক ও তথাকথিত খারাপ আবহাওয়ার সুযোগে এর শাসনকর্তাগণ সহজেই দিল্লির আধিপত্য অগ্রাহ্য করে আসা প্রদেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে সক্ষম হতেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ঈসা খাঁর মতো একজন জমিদার সম্রাট আকবরের ন্যায় প্রতাপশালী বাদশাহের বাহিনীকে ঠেকিয়ে বাংলার স্বাধীনতা বজায় রেখেছিল।
৩. মানুষের জীবনধারার ক্ষেত্রে প্রভাব : মানুষের জীবনধারা ও ভূপ্রকৃতির মধ্যে রয়েছে গভীর যোগসূত্র, সামগ্রিক জীবনযাত্রার উপর ভূপ্রকৃতির প্রভাব সুস্পষ্ট। ভূপ্রকৃতির কারণে কোথাও জীবনযাত্রা কঠিন আবার কোথাও সহজ। যেমন- পার্বত্য অঞ্চলে জীবনযাত্রা কঠিন, আবার সমতলে সহজ প্রকৃতির। কোথাও জীবনযাত্রা নিম্নশ্রেণির আবার কোথাও উন্নত প্রকৃতির। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সমতলে ঘনবসতি আর পার্বত্য অঞ্চলে বসতি কম দেখা যায়।
৪. ব্যবসায় বাণিজ্যের উপর ভৌগোলিক প্রভাব : ব্যবসায় বাণিজ্যের উপর ভৌগোলিক প্রভাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কারণ ভৌগোলিক অবস্থার উপর নির্ভর করে ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশেষকরে সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্যে অপেক্ষাকৃত তারতম্য লক্ষ করা যায়।
৫. যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর ভৌগোলিক প্রভাব : যোগাযোগ ব্যবস্থা ভূপ্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশ নদীমাতৃক হওয়ায় এখানে নিম্ন এলাকায় যোগাযোগের মাধ্যম হলো নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার। সমতল অঞ্চলে সৃষ্টি হয়েছে কাঁচা পাকা রাস্তা যা যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজীকরণ করেছে। আবার পাহাড়ি অঞ্চল সমতল না হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত।
৬. কৃষ্টি ও সভ্যতার উপর ভৌগোলিক প্রভাব : মানুষের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড গড়ে ওঠে ভৌগোলিক অবস্থা দ্বারা বাংলাদেশে সমতল ভূমির মানুষেরা সংস্কৃতির চর্চা বেশি করে থাকে। পাহাড়ি ও সমতল ভূমির লোকদের মধ্যে ভূপ্রকৃতির বা সংস্কৃতি ও কৃষ্টি ভিন্নতর পরিলক্ষিত হয়।
৭. অপরাধ সৃষ্টিতে ভৌগোলিক প্রভাব : ভৌগোলিক অবস্থার কারণে অপরাধ প্রবণতার হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে অপরাধ প্রবণতার হার বেশি। অন্যদিকে, সমতল অঞ্চলে অপরাধ প্রবণতা কম। এছাড়া ভূপ্রকৃতির কারণে নগরে বেশি মাত্রায় অপরাধ সংঘটিত হয়।
৮. নগরায়ণে প্ রভাব : নগরায়ণের বিস্তার ঘটে সমুদ্র ও নদীতীরবর্তী স্থানে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত। চট্টগ্রাম নগর কর্ণফুলি নদীর তীরে অবস্থিত। ফলে নগরায়ণে ভূপ্রকৃতির প্রভাব ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ।
৯. শিল্পায়ন প্রভাব : শিল্পায়নের উপর ভৌগোলিক প্রভাব সুস্পষ্ট। সাধারণত নদীর তীরে শিল্প কলকারখানা গড়ে ওঠে। যেমন- রাজশাহীর রেশম শিল্প, সিলেটের চা শিল্প, রাজশাহী অঞ্চলের চিনিশিল্প প্রভৃতি।
১০. ভাষাগত প্রভাব : ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ভাষাগত প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় ভাষা দেখা যায়। বাংলাদেশে সমতল ভূমির ভাষা হলো বাংলায়। অন্যদিকে, পাহাড়ি বিভিন্ন উপজাতি নিজস্ব ভাষায় কথা বলে। ভাষাকে কেন্দ্র করে ১৯৫২ সালে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলাদেশে ভৌগোলিক অবস্থার প্রভাব দ্বারা এদেশের জনগণ গভীরভাবে প্রভাবিত। সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়সহ সমগ্র কর্মকাণ্ড ভৌগোলিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল । কাজেই সকলের উচিত ভূপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে পরিবেশ বান্ধব জীবন ব্যবস্থা গড়ে তোলা।