ইতিহাসের পরিধি সম্পর্কে আলোচনা কর।

অথবা, ইতিহাসের পরিধি যতটা বিস্তার করে সে সম্পর্কে তোমার মতামত তুলে ধর।
অথবা, ইতিহাসের পরিধি আলোচনা কর।
উত্তর৷ ভূমিকা :
ইতিহাস হল সমাজ, সভ্যতা ও মানুষের রেখে যাওয়া নিদর্শনের উপর গবেষণা ও সেখান থেকে অতীত সম্পর্কের সিদ্ধান্ত ও শিক্ষা নেবার শাস্ত্র। ইতিহাস সন্ধিবিচ্ছেদ করলে হয় ইতি হ আস, এই রকম ছিল। বাংলা ইতিহাস শব্দটির ইংরেজি পরিভাষা হচ্ছে হিস্টোরি। গ্রীক শব্দ হিস্টোরিয়া থেকেই এই হিস্টোরি শব্দটির উৎপত্তি।


ইতিহাসের পরিধি : সাধারণ অর্থে পরিসর, পরিসীমা, সীমানা বা কার্যক্ষেত্রকে পরিধি বলা হয়। তবে ইতিহাসের পরিধি ভিন্ন অর্থে প্রকাশ করা হয়। অর্থাৎ ইতিহাসের কার্যক্ষেত্রের সুবিশাল দিগন্তকে বা ইতিহাসের কার্যক্ষেত্রের পরিধি যতটা বিস্তার লাভ করে তার পরিমণ্ডলকে ইতিহাসের পরিধি বলা হয়।
তাই ইতিহাসের পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত। নিচে ইতিহাসের পরিধি সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
প্রাগৈতিহাসিক যুগে ইতিহাসের পরিধি : প্রাগৈতিহাসিক যুগের ইতিহাসের পরিসীমা নির্ভর করে ঐ যুগের মানুষের কর্মপরিসর তথা পরিসীমার বিস্তার পর্যন্ত। তবে এ যুগের ইতিহাসের পরিধি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করতে পারেনি। কারণ এ যুগের মানুষ তত্ত্বগতভাবে, তথ্যগতভাবে, পরিকল্পনাগতভাবে সর্বোপরি বাস্তব ও ব্যবহারিক কর্মের মাধ্যমে বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারেনি। তাদের বাস্তব কর্মজীবন ছিল সংক্ষিপ্ত পরিসরে। ফলে এ যুগের ইতিহাসের পরিসীমাও স্বল্প বিস্তার লাভ করেছিল। আমরা জানি, ইতিহাসের মূল বিষয়বস্তু মানুষ। তাই মানুষের কর্মকাণ্ডই ইতিহাস আলোচনা করে। মানুষ তার কর্মকাণ্ড নিয়ে যতদূর এগিয়ে যাবে ততদূরই ইতিহাসের আলোচনার পরিধি হবে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ তার কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশি দূর এগিয়ে যেতে পারেনি। তাই ইতিহাসের পরিধিও ততটা এগিয়ে যেতে পারেনি ।
ঐতিহাসিক যুগে ইতিহাসের পরিধি : প্রাগৈতিহাসিক যুগ পেরিয়ে যখন ঐতিহাসিক যুগে মানুষ পদার্পণ করে তখন তার কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। ফলে ইতিহাসের পরিধিও বেড়ে যায়। এ যুগে এসে ইতিহাসের পরিধি ক্রমসম্প্রসারিত দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। এ সময় প্রাচীন যুগের ন্যায় লিখিত ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়। ফলে ইতিহাস রচনা সম্ভব হয়ে ওঠে এবং ইতিহাসের পরিধিও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ সময় ইতিহাসের জনক হিরোডোটাসের আবির্ভাব ঘটে এবং ইতিহাস রচনায় ব্যাপক উৎসাহ, উদ্দীপনা দেখা দেয়। এতে ইতিহাসের কর্মপন্থাও বেড়ে যায়। ফলে ইতিহাসের পরিধি বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে যায়। এ ঐতিহাসিক যুগকে আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায় এবং পরিধিও ভাগ হয়ে যায়। যেমন-
প্রাচীন যুগ : প্রাচীন যুগে ইতিহাসের পরিধি চলে যায় রাজনীতির পরিমণ্ডলের আবর্তে। এ সময় রাজনৈতিক ঘটনাবলি ব্যাপক বৃদ্ধি পেতে থাকে। তথা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপক বিস্তার লাভ করে, যার সাথে ইতিহাসের পরিধি ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। এ সময় রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের শাসননীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সভ্যতা, সংস্কৃতি, স্থাপত্যকর্ম ইতিহাসের পরিধি অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পাশাপাশি ধর্মও ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয়। ফলে ধর্ম হয়ে যায় রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তবে এ সময় যুদ্ধবিগ্রহই ছিল ইতিহাসের মূল উপজীব্য। এ সময় যদিও ঐতিহাসিকদের রচনায় রাজনীতি ও যুদ্ধনীতি স্থান পেয়েছে, তথাপি সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, স্থাপত্য, ধর্ম প্রভৃতি গুরুত্বহীন ছিল না। এটাই ইতিহাস পরিধির অন্তর্ভুক্ত করে নেয়।
মধ্যযুগ : ইতিহাসের পরিধি মধ্যযুগে এসে আরো বিস্তার ল াভ করে। কারণ এ সময় ব্যবসায় বাণিজ্যের আবির্ভাব ঘটে এবং সমগ্র বিশ্ব পরিচিত হতে থাকে। কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে মানুষের কর্মকাণ্ডও ব্যাপক বৃদ্ধি পায় যার সাথে ইতিহাসের পরিধিও ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। এ সময় ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের প্রভাবে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সংযোগ স্থাপিত হতে থাকে। ফলে এ যুগে ইউরোপের সাথে ভারত ও আফ্রিকা মহাদেশের রাজনীতি ও সমাজনীতি স্থান করে নেয়। এ সময় ভারতে রাজনীতিতে ধর্মের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। ভারতবর্ষসহ সমগ্র এশিয়াতে মধ্যযুগে ধর্ম প্রভাব বিস্তার করে এবং কোনো কোনো স্থানে ধর্মনীতি রাষ্ট্রনীতিতে পরিণত হয়। ফলে ইতিহাসের পরিধি ধর্ম ও রাষ্ট্রের সাথে একীভূত হয়ে যায়।
আধুনিক যুগ : মধ্যযুগে ধর্মতন্ত্রের প্রভাব শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এ সময় ধর্মকর্মে নিয়োজিত পোপগণ চরম দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। ফলে পোপের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণঅসন্তোষ জন্ম নেয়। সুযোগে কিছু রাষ্ট্রনায়ক ধর্মতন্ত্রের প্রভাব খর্ব করে রাষ্ট্রতন্ত্রের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। ফলে রাজনীতির প্রভাব ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় এবং ক্রমবিস্তার সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া এ সময় মানুষের মধ্যে ধর্মের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবতাবাদের নীতি আশ্রয় নেয়। ফলে শুরু হয় আধুনিক যুগ এবং এ যুগ কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে আগমন করে। এ যুগের কর্মকাণ্ড সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আধুনিক যুগের ইতিহাসের পরিধি কোন নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে তা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এ যুগ শুরু হয় ধর্মসংস্কার ও রেনেসাঁর মাধ্যমে। এতে মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক জগতে যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে তার ছোঁয়া লাগে ইতিহাসের গায়ে এবং এর ফলে ইতিহাসের পরিধিরও পরিবর্তন ঘটে। আধুনিক যুগ শুরু হয় পঞ্চাশ শতকে এবং তা বিংশ শতক পর্যন্ত চলে।
উত্তর আধুনিক যুগ : ইতিহাসের পরিধি আধুনিক যুগে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে এবং উত্তর আধুনিক যুগে এসে তা পরিপূর্ণতা লাভ করে। কারণ বিশ্বায়ন কথাটি প্রচারিত হয় এ যুগে এবং ইতিহাসের পরিধিও বিশ্বায়নের দিকে চলে যায়। বিশ্বায়নের ফলে সমগ্র বিশ্ব একই ছাতার নিচে এসে যায়। এ সময় গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বিশ্বায়নে পরিণত হতে সাহায্য করেছে। ফলে ইতিহাসের পরিধিতে নবযাত্রা যোগ করে এবং এ সময় সমসাময়িক কালের মানবসভ্যতার উপর ইতিহাস লেখার গুরুত্ব ব্যাপকভাবে অনুভূত হয়।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইতিহাসের পরিধি কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়। এটা যুগ যুগ ধরে বিস্তার লাভ করেছে। সেই প্রাচীনকালে ইতিহাসের পরিধির বিস্তার লাভ শুরু হয়েছে, যা বর্তমান পর্যন্ত চলছে। আজ ইতিহাসের পরিধি বিশ্বায়নের সাথে একীভূত হয়ে ইতিহাসের পরিধিও বিশ্বায়ন পরিধিতে রূপান্তরিত হয়েছে।

https://topsuggestionbd.com/%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%a5%e0%a6%ae-%e0%a6%85%e0%a6%a7%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a7%9f-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%a7%e0%a7%80%e0%a6%a8-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%82-2/