অথবা, জাতীয় উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের ভূমিকাসমূহ বর্ণনা কর।
অথবা, জাতীয় উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের অবদানগুলো বিশ্লেষণ কর।
উত্তর৷। ভূমিকা : জাতীয় উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের ভূমিকা ও অবদান যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। গ্রামীণ ব্যাংক বিনা জামানতে গরিবদের মাঝে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করে গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ৪৪,৬৩৬টি গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংকের নেটওয়ার্ক বিস্তার করে সর্বমোট ৩৩,৫৬,৬৪১ জন সদস্যকে এর সুবিধা কাঠামোর আওতায় এনেছে। ফলে দেশের ৩৩ লক্ষ ৫৬ হাজার ৬৪১টি পরিবারই উপকৃত হচ্ছে। এসব পরিবারের দারিদ্র্যদশা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে এবং আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাতীয় উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের ভূমিকা ও অবদান : নিম্নে জাতীয় উন্নয়নে গ্রামীণ ব্যাংকের ভূমিকা ও অবদান উল্লেখ করা হলো :
১. নারী কল্যাণ : নারী কল্যাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে তার মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান। গ্রামীণ ব্যাংক নারীদের সংগঠিত করতে বহুলাংশে সফল হয়েছে। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের নারী সদস্যের সংখ্যা ৭.৯৭ মিলিয়ন। এসব নারীকে গ্রামীণ ব্যাংক শুধু ঋণ প্রদান করেই সহায়তা করে নি, বরং নারীদেরকে বিভিন্নভাবে সচেনতনতার শিক্ষা প্রদান করেছে। নারীদেরকে সচেতন করার ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের ষোলো সিদ্ধান্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এ ষোলো সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে-
i. পরিবারকে ছোট রাখা,
ii. ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করা,
iii. স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার করা,
iv. স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেয়া,
v. সবজি উৎপাদন করা ইত্যাদি।
এগুলো শুধু নারী কল্যাণই নয়, বরং পরিবারের উন্নতির মূলমন্ত্র হিসেবে কাজ করে।তাছাড়া নারীদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংক সহায়তা করেছে।
২. গৃহ ব্যবস্থার উন্নয়ন : আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ গরিব। আর গরিব মানুষেরা ভালো গৃহে বসবাস করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।তারা স্বাস্থ্যসম্মত গৃহে বাস করতে পারে না। গ্রামীণ ব্যাংক তার সদস্যদেরকে গৃহ ঋণ সুবিধা দিয়ে গৃহের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০০৪ সালের তথ্যানুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ সহায়তায় ৬ লক্ষ সদস্য গৃহ ঋণ সুবিধা পেয়েছে এবং ৬ লক্ষ পরিবার উপকৃত হয়েছে। গৃহ সুবিধা মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সাহায্য করেছে।
৩. শিক্ষার উন্নয়ন : গ্রামীণ ব্যাংকের স্বাক্ষরতার অভিযান খুবই ফলপ্রসূ।যারাই গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণগ্রহীতা তারাই সাক্ষরতা জ্ঞান লাভ করে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রচেষ্টায়। এছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক যে শিক্ষা বৃত্তি চালু করেছে তা শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাছাড়া উচ্চশিক্ষার জন্য গ্রামীণ ব্যাংক শিক্ষা ঋণের ব্যবস্থা করেছে, যা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
৪. উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা : গ্রামীণ ব্যাংক দেশের উৎপাদন বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখছে। চকরিয়ায় চিংড়ি উৎপাদন প্রকল্প ও জয়সাগর মৎস্য খামার প্রকল্প দেশে মাছের উৎপাদন যথেষ্ট বৃদ্ধি করেছে। তাছাড়া পতিত পুকুরগুলো সংস্কারের ব্যবস্থা করেছে গ্রামীণ ব্যাংক। এসব পুকুরে প্রচুর পরিমাণে মাছ উৎপাদন হচ্ছে।আবার গ্রামীণ ব্যাংক তার সদস্যদের মাঝে গাভী বিতরণ করেছে। গাভী থেকে প্রচুর পরিমাণে দুধ উৎপাদিত হচ্ছে।সুতরাং আমরা বলতে পারি, গ্রামীণ ব্যাংক দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখছে এবং আমিষের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
৫. স্বাস্থ্য উন্নয়ন : গ্রামীণ ব্যাংক তার সদস্যদের মাঝে টিউবওয়েল স্থাপন ও স্যানিটেশন ল্যাট্রিন স্থাপনে ঋণ দেয় এবং টিকাদান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। তাছাড়া গ্রামীণ ব্যাংক
ের কর্মীরা প্রায় ৩৪ লক্ষ নারী-পুরুষ সদস্যের স্বাস্থ্যগত উন্নয়নেও অবদান রাখছে। Atiur Rahman বলেছেন, “More than 90% of the GB loaners know, how to prepare oral saline. At best 64% of the loaners do use birth control method.”
৬. অর্থনৈতিক উন্নয়ন : গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০০৯ সালের তথ্যানুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংক ক্রমপুঞ্জীভূত ৭০৩০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এ ঋণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এতে মানুষের আয় বাড়ছে, ভোগ বাড়ছে ও জীবনযাত্রার মানেরও উন্নয়ন ঘটছে।
৭. পুষ্টির উন্নয়ন : গ্রামীণ ব্যাংক মানুষের পুঁজির উন্নয়নেও সহায়তা করেছে। খাদ্য বা ক্যালরি গ্রহণের ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের দরিদ্র সদস্যরা অন্যান্য দরিদ্র লোকদের চেয়ে এগিয়ে আছে।
৮. মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি : গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও গ্রামীণ ব্যাংকের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। দেখা গেছে একই পর্যায়ের দরিদ্রদের মধ্যে যারা গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য তাদের মাথাপিছু আয় যারা সদস্য নয় তাদের চেয়ে বেশি।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনা শেষে আমরা বলতে পারি, জাতীয় উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গ্রামীণ ব্যাংকের অবদান রয়েছে । গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কর্মসূচির ফলে প্রায় ৩৪ লক্ষ পরিবার চরম দরিদ্রদশা থেকে মুক্তি পেয়েছে।ফলে জাতীয় দারিদ্র্যের হার কিছুটা হলেও কমেছে। তাছাড়া গৃহ ঋণ সুবিধার ফলে প্রায় ৬ লক্ষ পরিবার ভালো গৃহে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছে। ২০০৪ সালের তথ্যানুযায়ী, ৫৩,২৩৭ জন মহিলা সদস্য গ্রামীণ ফোন নিয়েছে। তারা মোবাইল
ফোন ব্যবহার করে পরিবারের আয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হচ্ছে। গ্রামীণ ব্যাংক মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখছে। দেখা গেছে, একই শ্রেণিভুক্তের মধ্যে যারা গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য তাদের মাথাপিছু আয় ১৬-৩৩% বেশি, আবার বিভিন্ন স্থানে মৎস্য খামার স্থাপন করে এবং গ্রামীণ ব্যাংক তার সদস্যদেরকে গাভী পালনের সুযোগ দিয়ে দেশে আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখছে।সর্বোপরি গ্রামীণ ব্যাংক বিভিন্ন মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে সাহায্য করছে,জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে সাহায্য করছে এবং মানুষকে সচেতন করে গড়ে তুলছে।