বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসেবে সামাজিক গবেষণা মূল্যায়ন কর।
অথবা, গবেষণা কিভাবে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানার্জনে সহায়তা করে আলোচনা কর।
উত্তরঃ ভূমিকা : মানব সভ্যতার চরম বিকাশের মুহূর্তে সামাজিক গবেষণা আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বের দাবিদার । কোনোকিছু সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা দ্বারা পরিচালিত হয়ে ব্যাপক জ্ঞান লাভ করাকে সামাজিক গবেষণা বলা হয়। এটি বিশেষ যুক্তিপূর্ণ নীতিমালা দ্বারা পরিচালিত হয়ে ব্যাপক জ্ঞান লাভ করাকে সমস্যার কারণ ও ক্ষতিকর প্রভাব এবং অজানাকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে পুরাতন পদ্ধতি নিরীক্ষা করে নতুন পদ্ধতির আবিষ্কার করা হয় । বর্তমানে সমাজের বিভিন্ন ঘটনা, সমস্যা ও তার সমাধানের জন্য সামাজিক গবেষণার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি হিসেবে সামাজিক গবেষণা মূল্যায়ন : সামাজিক বিজ্ঞানকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসারী বলে দাবি করা হয় । বস্তুত সামাজিক বিজ্ঞানসমূহে ব্যবহৃত বিভিন্ন অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ পদ্ধতির বিচারে পদ্ধতির অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যগুলো মোটামুটিভাবে অনুসরণ করা চলে । পরীক্ষণ পদ্ধতিকে সামাজিক গবেষণার অন্যতম স্বরূপ হিসেবে বিবেচনা করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যগুলো যাচাই করা যেতে পারে। তবে অন্যান্য পদ্ধতিগুলো সর্বাংশে না হলেও অনেকাংশে এবং প্রচ্ছন্নভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে চলার চেষ্টা করে। সঙ্গত কারণে এসব পদ্ধতিকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ না বলে ‘কম বৈজ্ঞানিক’ বলে চিহ্নিত করা হয়। এবারে সামাজিক গবেষণার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণের
ধরন বিচার করা যেতে পারে নিম্নোক্তভাবে :
১. বাস্তবমুখী তথ্য নির্ভরতা : বিজ্ঞান তার সত্য প্রতিষ্ঠায় পরীক্ষা-নিরীক্ষালব্ধ তথ্যের উপর সর্বাংশে নির্ভরশীল। সমাজিক গবেষণাও সামাজিক পরিবেশ থেকে বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তথ্যাবলি সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।
২. পূর্ববলন : প্রাপ্ত তথ্য বা সত্যের ভিত্তিতে বিজ্ঞান নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকে। সমাজ গবেষক সামাজিক বিষয় সম্পর্কিত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভাবনা নির্ভর ভবিষ্যদ্বাণী করে থাকে। যেমন- অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেলে অপরাধ প্রবণতাও বৃদ্ধি পাবে।
৩. প্রাসঙ্গিক ধারণার ব্যবহার : বিজ্ঞান তার অনুসন্ধান কাজে বিশ্লেষণাধীন বিষয়-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধারণা বিবেচনা ও ব্যবহার করে থাকে। এতে করে চিন্তা ও সত্যের পারস্পর্য বজায় থাকে। সামাজিক গবেষণা সমাজ সম্পর্কিত যে কোনো বিষয়ের উপর অনুসন্ধান কাজ চালাতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর প্রভাব বিবেচনার চেষ্টা করে।
৪. পুনরাবৃত্তি : বিজ্ঞান প্রাপ্ত সত্যের যথার্থতা সম্পর্কে একই ধরনের ফলাফলের পুনরাবৃত্তির কথা ঘোষণা করে থাকে। সামাজিক গবেষণা এক্ষেত্রে তার সত্যের পুনরাবৃত্তির সম্ভাব্যতার কথাই মাত্র তুলে ধরতে সক্ষম। অর্থাৎ, পরীক্ষণপত্র বা সামাজিক উপাদানের উপর সমাজ গবেষকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না থাকাতে শর্তসাপেক্ষে গবেষণার পুনরাবৃত্তি
করা সম্ভব হয়।
৫. নিয়ন্ত্রণ : বিজ্ঞান সুনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সত্য উদ্ঘাটনে বিশ্বাসী । সমাজ গবেষণা সমাজ সম্পর্কিত বিষয়াবলিকে গবেষণারগারে আবদ্ধ করতে পারে না। তবে এক্ষেত্রে যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয় । সফলজনক এসব কৌশলের প্রয়োগ সমাজ গবেষককে আপেক্ষিকভাবে নিয়ন্ত্রণক্ষম করে তোলে।
৬. উদ্দেশ্যমুখী : বিজ্ঞান সবসয়মই সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সামনে রেখে এগিয়ে চলে। সামাজিক গবেষণাও সামাজিক সত্য উন্মোচনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ।
৭. পরিমাপ : বিজ্ঞানের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হলো তার প্রাপ্ত তথ্যের পরিমাপযোগ্যতা। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো সামাজিক গবেষণা তার সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারে না। তবে চুলচেরা পরিমাপ না করতে পারলেও তুলনামূলক পরিমাপ করা সমাজ গবেষকের পক্ষে সম্ভবপর হয়ে থাকে। সত্যিকার অর্থে, সমাজ গবেষণার প্রাথমিক ও প্রধান দুর্বলতাই হচ্ছে মাত্রাগত পরিমাপে অপারগতা । অর্থাৎ, কতটুকু দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেলে কতটুকু অপরাধ প্রবণতা বাড়বে,
তা সমাজ গবেষক পরিমাপ করতে পারেন ।
৮. মূল্যবোধ নিরপেক্ষতা : বিজ্ঞান পক্ষপাতহীন। বৈজ্ঞানিক মূল্যবোধ ছাড়া বিজ্ঞানে অন্য কোনো মূল্যবোধের অবস্থান অনুপস্থিতি অবাঞ্ছিত। সামাজিক গবেষণা বিভিন্ন ধরনের মূল্যবোধের প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে পারে না । কিন্তু অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে সামাজিক গবেষণা নিরপেক্ষতা বাজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে ।
৯. সর্বজনীন : বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত সর্বজনীন। সামাজিক গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত সামাজিক বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তসমূহ প্রাকৃতিক বিজ্ঞান প্রদত্ত সিদ্ধান্তের মতো ততটা সুনিশ্চিত নয়। কেননা, সামাজিক বিষয় অত্যন্ত পরিবর্তনশীল। তাই সামাজিক গবেষণালব্ধ সকল সিদ্ধান্তের বিশ্বজোড়া সমগ্রহণযোগ্যতা তেমনটা নেই বললেই চলে। তবে সীমিত ক্ষেত্রে হলেও সামাজিক গবেষণালব্ধ সকল সিদ্ধান্তের বিশ্বজোড়া সমগ্রহণযোগ্যতা তেমনটা নেই বললে চলে। তবে সীমিত ক্ষেত্রে হলেও সামাজিক গবেষণা তুলনামূলকভাবে তার সিদ্ধান্ত সাধারণীকরণের চেষ্টা করে। এর ফলশ্রুতিতে সমাজভেদে বিভিন্ন সাধারণ অবস্থার প্রকৃতি সর্বজনীন করা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্ভব হয়েছে। পরিমাপের দুর্বলতাই সমাজ গবেষককে সিদ্ধান্ত সাধারণীকরণে নমনীয় করে রাখে ।
উপসংহার : উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সামাজিক গবেষণা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সবগুলো বৈশিষ্ট্য অনুসরণের চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু সদাপরিবর্তশীল এবং গুণগত সামাজিক বিষয় বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের ধারা সম্পূর্ণভাবে বজায় রাখা সম্ভবপর হয় না।