অথবা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ সামাজিক শ্রেণির বর্ণনা কর।
অথবা, বাংলাদেশের গ্রামীণ বাংলাদেশের শ্রেণি কাঠামোর বাখ্যা কর।
অথবা, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ সামাজিক শ্রেণির বিবরণ তুলে ধর।
উত্তর৷ ভূমিকা : কোনো সমাজই শ্রেণিহীন নয়, সব সমাজেরই শ্রেণি কাঠামো রয়েছে। পৃথিবীর সকল মানবসমাজের ন্যায় আমাদের বৃহত্তর গ্রামীণ সমাজেই ধনীগরিব, উঁচুনিচু শ্রেণি বিদ্যমান। এসব শ্রেণি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। বহু বছরের আবর্তন ও বিবর্তনের ফল হচ্ছে আমাদের আজকের সমাজ। গ্রামীণ সহজসরল জীবনের মাঝে ধর্মভিত্তিক শ্রেণিবিভাগকে কেন্দ্র করে অভিজাত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল প্রাচীনকালে। ক্রমান্বয়ে এর পরিবর্তন হয়ে গ্রামীণ মানুষের জীবনধারার মান নির্ণয়ের পর্যায়ে এসেছে।
গ্রামীণ বাংলাদেশের শ্রেণি কাঠামো বা সামাজিক শ্রেণি : বাংলাদেশ গ্রামের দেশ। এ দেশের সমাজকাঠামো এবং সংস্কৃতি গ্রামকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে। আমরা বাংলাদেশের গ্রাম সমাজকাঠামোতে শ্রেণি নির্ধারণ অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে লক্ষ্য করতে পারি। আর্থিক পরিস্থিতি বা সম্পত্তির অধিকারের ভিত্তিতে বাংলাদেশের গ্রাম সমাজব্যবস্থায় স্তরবিন্যাস বা শ্রেণি সমন্বয় (Social stratification or composition of social class) করা হয়। গ্রামের অর্থনীতি হচ্ছে কৃষি এবং সম্পদ হচ্ছে ভূমি। কৃষকরা হচ্ছে গ্রামের প্রধান উৎপাদক শ্রেণি। এ উৎপাদক শ্রেণির আর্থিক অবস্থা সকলের এক রকম নয়। কারণ ভূমি মালিকানার (Land Ownership) উপর নির্ভর করে আর্থিক সচ্ছলতা। ফলে গ্রাম সমাজে কৃষক উৎপাদক শ্রেণি হওয়া সত্ত্বেও ভূমি মালিকানার ভিত্তিতে তিনটি শ্রেণির অস্তিত্ব লক্ষণীয় । যথা :
১. ভূমি মালিক বা বর্ধিষ্ণু কৃষক (Land owner peasant)
- বর্গদারি কৃষক (Baurgadar peasant) এবং
৩. ভূমিহীন কৃষক (Landless peasant)
নিম্নে এ তিনটি শ্রেণি সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো :
Siga
১. ভূমি মালিক কৃষক (Land owner peasant) : গ্রাম সমাজে বর্তমানে যারা ভূমি মালিক তাদের আর্থিক অবস্থা সচ্ছল বলা চলে। সমাজে ভূমি মালিকানা লাভ ও উৎপাদনের অনুকূল অবস্থা তাদেরকে নিজ ক্ষমতায় ও যোগ্যতায় গর্বিত করেছে। ফলে গ্রাম সমাজে তাদের প্রতিপত্তি ও আধিপত্য প্রথম পর্যায়ে বলা চলে।
২. বর্গাদারি কৃষক (Baurgadar peasant) : বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে মধ্য শ্রেণির পর্যায়ে রয়েছে বর্গাদারি কৃষক। বর্গদারি কৃষক বলতে বুঝায় যাদের নিজস্ব কৃষি উপযোগী ভূমি রয়েছে, কিন্তু তার উপর নির্ভর করে আর্থিক
সচ্ছলতা লাভ করা যায় না। এরূপ ক্ষেত্রে কৃষকরা অন্যের ভূমিতে চাষ করে। এর বিনিময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ ফসল বা বাৎসরিক হিসেবে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা প্রদান করে। ফলে এক্ষেত্রে বর্গাদারকারী ভূমি মালিক ভূমির উপর থেকে নির্দিষ্ট আয় লাভ করে । অপরপক্ষে, বর্গা গ্রহণকারী কৃষক ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে সচ্ছলতা লাভ করে ।
৩. ভূমিহীন কৃষক (Landless peasant) : গ্রামীণ সমাজে আরও এক শ্রেণির খোদ কৃষক রয়েছে, কিন্তু আর্থিক অভাব অনটনে তাদের ভূমির মালিকানা হারিয়েছে। তাদেরকে আমরা ভূমিহীন কৃষক বলে আখ্যায়িত করে থাকি। এসব ভূমিহীন কৃষক অন্যের ভূমিতে তাদের শ্রমদান করে জীবিকানির্বাহ করে থাকে। বাংলাদেশের গ্রাম সমাজে এসব কৃষক শ্রেণি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অনেকে বর্তমানে কৃষিকাজের অভাবে এবং অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার জন্য গ্রাম ছেড়ে শহরে কাজের সন্ধানে ছুটে যায়।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামীণ শ্রেণি কাঠামো বা বিরাজমান শ্রেণি নির্ধারণ করতে গিয়ে জমির মালিকানা
যেমন ব্যবহার করা হয়েছে, অন্যান্য আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্যও তেমন ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশের গ্রাম সমাজ উল্লেখযোগ্য অর্থে শ্রেণিবিভক্ত। এ শ্রেণিবিভক্ত কাঠামোতে জমির অসম বণ্টন উল্লেখযোগ্য। জমির অসম বণ্টন অর্থনৈতিক অবস্থা প্রতিফলিত করে। বিভিন্ন গবেষক বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির কথা বলেছেন। B. K. Jahangir চারটি শ্রেণির কথা উল্লেখ করেন; যথা : ভূমিহীন, দরিদ্র কৃষক, মধ্য কৃষক
এবং ধনী কৃষক। K. Siddiqui সাতটি শ্রেণির কথা বলেছেন, যথা : ভূমিহীন, দরিদ্র কৃষক, নিম্নমাঝারি কৃষক, মধ্যমাঝারি কৃষক, উচ্চমাঝারি কৃষক, ধনী কৃষক ‘এক’ ও ধনী কৃষক ‘দুই’। উল্লেখ্য যে, জাহাঙ্গীর কাজ করেছেন ঢাকা জেলায়, , সিদ্দীকী যশোর জেলায়। অর্থাৎ, দেখা যায় গ্রামীণ শ্রেণিবিন্যাস অঞ্চলভেদে পার্থক্য রয়েছে।
W. V. Schendel শ্রেণি প্রত্যয়কে জটিল বলেছেন গ্রামীণ বাস্তবতার প্রেক্ষিতে। তিনি গ্রামীণ গৃহস্থালিকে চারটি অর্থনৈতিক প্রকরণে ভাগ করেছেন এবং প্রকরণগুলো চারটি ইংরেজি বর্ণের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন, যথা : A, B, C, D সবচেয়ে নিচে যাদের অবস্থান, অর্থাৎ প্রকরণ A তারা পুরো বছর খাদ্য সংগ্রহে অক্ষম এবং জীবনমান অত্যন্ত নিচু স্ত
রের। এদের ঠিক উপরে যারা, অর্থাৎ B প্রকরণ, তাদের জীবনমান নিচু হলেও নিয়মিত খাদ্য সংগ্রহে সক্ষম। এদের উপরে যারা (C প্রকরণ) মাঝারি ধরনের অবস্থা এবং কিছুটা উদ্বৃত্ত সৃষ্টিতে সক্ষম। সবচেয়ে উপরের অংশটি স্বচ্ছন্দে চলতে পারে এবং উল্লেখযোগ্য উদ্বৃত্ত সৃষ্টিতেও সক্ষম। গ্রাম বাংলায় শ্রেণি সচেতনতার অভাবের ব্যাপারটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে এরিক ইয়ানসেন মনে করেন।
এ প্রেক্ষিতে তিনি ভিন্ন একটি উপাদানের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাজন করেছেন। তা হচ্ছে ভাতের সংস্থানের ক্ষমতা (Rice | consumption capacity) প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায় গৃহস্থালিসমূহকে। এ মাত্রায় প্রথম অংশটি ভাতের সম্পূর্ণ
| সংস্থানে সক্ষম নয়, দ্বিতীয় অংশটি স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং তৃতীয় অংশ বা শ্রেণিটি কিছুটা উদ্বৃত্ত সৃষ্টিতে সক্ষম।
বর্ণ ও বংশভিত্তিক শ্রেণি : বাংলাদেশের গ্রা মীণ হিন্দু সমাজব্যবস্থায় বর্ণভিত্তিক শ্রেণি পরলক্ষিত হয়। গ্রাম সমাজে বর্ণবিভাগ বংশানুক্রমিক এবং প্রধানত পেশাগত; যেমন- জেলে বংশানুক্রমে জেলে, কামার বংশানুক্রমে কামার সাহা বংশানুক্রমে ব্যবসায়ী। বর্তমান গ্রাম সমাজে আশরাফ বংশের বলে দাবি করা হয় চৌধুরী, মিঞা, ভূঁইয়া, কাজী, সৈয়দ, খন্দকার এবং আতরাফ বলে গণ্য করা হয় তাঁতি, গ্রামের কৃষক, মাঝি, কামার, কুমার ছুতার ইত্যাদি। তাছাড়া | বাংলাদেশের গ্রাম সমাজে শিক্ষক, ডাক্তার, ব্যবসায়ী শ্রেণি উচ্চতর মর্যাদা লাভ করে ।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, যুগ যুগ ধরে শ্রেণি সংঘাতের মাধ্যমে সমাজ এগিয়ে চলছে। আর্থিক বা পেশাগত দিক থেকে এবং ব্যক্তির চিন্তার ক্ষেত্রে সমাজে বহু তারতম্য পরিলক্ষিত হয় এবং এভাবে সমাজ বহুধা বিভক্ত। বাংলাদেশের গ্রামীণ শ্রেণি কাঠামো পর্যালোচনায় বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত বিষয়টিকে বিশেষত্ব দান করেছে। প্রকৃত সত্য
অনুধাবনে যেটি করণীয় তা হলো গবেষকের বস্তু নিরপেক্ষ অবস্থান ও আরও বিস্তৃত পর্যায়ে মাঠ গবেষণা। কারণ শ্রেণির প্রয়োজনীয়তা সর্বকালীন। সমাজে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের একটি সংগঠনের ভিত্তিতে টিকে থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এজন্যই বাংলাদেশের গ্রাম সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি বিরাজমান।