অথবা, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুরভাবে হত্যা সম্পর্কে আলোচনা
কর।
উত্তর ভূমিকা : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডটি ছিল সুপরিকল্পিতভাবে একটি দেশের কর্ণধারকে হত্যা করে তাঁর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে শুধু সংবিধান থেকে নয় বাঙালির মন ও মগজ থেকে মুছে ফেলা। যার ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালি জাতি, ছাত্র, জনতা, কৃষক যুদ্ধে গিয়েছিল। যার
বজ্রকণ্ঠ মস্তিষ্কে প্রতিধ্বনি তোলে তাঁকে হত্যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের সাথে বেঈমানি করা।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যার কারণ : নিচে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হন তা নিম্নরূপ :
১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচ্ছিন্নতা : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। পাকিস্তান আমলে তাঁকে মুজিব ভাই, ঊনসত্তরে উপাধি পেল বঙ্গবন্ধু, তার বাংলাদেশ হওয়ার পর জাতির পিতা। তার জনপ্রিয়তা যতই বাড়ছিল, তাঁর ততই বাড়ছিল বিচ্ছিন্নতা। বিভন্ন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে তাঁর প্রতিপক্ষ সৃষ্টি
হয়েছিল। তবে বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিয়ে প্রতিবিপ্লবীরা তাঁকে আঘাত করেছে, হানাদার বাহিনী যাকে আঘাত করতে সাহস৷ পায়নি। স্বদেশী ঘাতকেরা তা করার সাহস পেয়েছে।
২. বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ : ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন করে। এ আইনে নিবর্তনমূলক অনেক বিধান রাখা হয়। অর্থাৎ সরকার যে কোন ব্যক্তিকে ক্ষতিকর কার্য থেকে বিরত রাখার জন্য আটক রাখতে পারবে মর্মে এ আইন ঘোষণা করা হয়। এ আইনে ১৯ ও ২০ নং ধারা বলে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ কোন সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণ করার বিধান করা হয়। ২৫ নং ধারায় মজুদদারি, কালোবাজারি, চোরাচালানি,
ভেজাল দেওয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীকে সাজা প্রদানের বিধান করা হয়।
৩. রক্ষীবাহিনী গঠন : আওয়ামী লীগের মুজিব বাহিনী থেকে এ রক্ষীবাহিনী গঠন করে দেশের নিরাপত্তা ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে নিয়োজিত করা হয়। রক্ষীবাহিনী গঠন ছিল সেনাবাহিনীর জন্য অমর্যাদাকর ও অসম্মানের। ষড়যন্ত্রকারীরা দেশের ভিতর নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি করলে সরকার জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের চিন্তাভাবনা করতে থাকে। মূলত এ বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য ছিল পুলিশকে সক্রিয় সাহায্য করা।
৪. বাংলাদেশ সৃষ্টি : বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু ছিল সমার্থক শব্দ। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পরাজয় এবং চীন মার্কিন কূটনৈতিক ব্যর্থতার ইঙ্গিতবহ ছিল। এ পরাজয় ও ব্যর্থতার প্রতিশোধ অনিবার্য ছিল। স্বাধীনতার পর থেকে৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার প্রচেষ্টা পরিস্ফুট হচ্ছিল। এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিল। বিশেষ করে ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা কয়েকবার সতর্ক করেছিল। বঙ্গবন্ধু তা আমলে নেননি।
৫. উচ্চাভিলাষ চরিতার্থে : বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পিছনে উচ্চাভিলাস চরিতার্থে কাজ করেছিল।
সেনাবাহিনীর বেশকিছু তরুণ বিপথগামী অফিসার ও সুবিধাবাদীদের উচ্চাভিলাস চরিতার্থে বঙ্গবন্ধু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল ।
৬. ফোনে আড়িপাতা : ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের পর থেকে পাকিস্তান প্রত্যাগতরা ও খুনিরা মিলে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে চক্রান্ত এত পাকাপোক্তভাবে করেছিল যে, তারা বঙ্গবন্ধুর সকল ফোন গোপনে বাগিং (আড়িপাতা) করতে শুরু করেছিল। বঙ্গবন্ধুর সকল কথাবার্তা আলোচনা ও কর্মকাণ্ড ষড়যন্ত্রকারীরা গোপনে মনিটর করে চলেছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পিছনে এটিও কাজ করেছিল ।
৭. আন্তর্জাতিক চক্রান্ত : বঙ্গবন্ধুর হত্যার পিছনে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত কাজ করেছিল। জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেলেও চীন ও সৌদি আরব স্বীকৃতি দেয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর। অন্যদিকে সে সময় সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যে প্রচণ্ড স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়। বাংলাদেশে সে সময় রাজনৈতিক ক্ষমতা সমাজতন্ত্রীদের হাতে চলে যেতে পারে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীকে অভ্যুত্থানে উৎসাহ দিয়েছিল।
৮. সাবধান বাণী উপেক্ষা : বঙ্গবন্ধু তাঁর হত্যার ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করতে থাকে। কর্নেল তাহের বঙ্গবন্ধুকে সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। তবে সে সাবধানবাণীকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে ‘৭৫ এর শোকাবহ ঘটনা ঘটত না।
৯. প্রতিবিপ্লব : বিপ্লব সচরাচর প্রতি বিপ্লবের শিকার হয়। একাত্তরের বিজয়ে সাড়ে তিন বছরের মাথায় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টে ভয়াবহ একটি হত্যাযজ্ঞ দিয়ে শুরু করে এ প্রতিবিপ্লব।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, সামরিক বাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য অত্যন্ত নির্মমভাবে সপরিবারে৷ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। হত্যার পিছনে নানাবিধ কারণ থাকলেও মূলত আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ও কতিপয় সেনাবাহিনীর
সদস্যের ভূমিকা ছিল মুখ্য। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালিকে হত্যা করে জাতিকে করা হয়েছিল কলঙ্কময়। তবে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করে জাতি কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত হতে পেরেছে।